বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হিমায়িত চিংড়ি রফতানি শিল্প। হোয়াইট গোল্ড নামে খ্যাত এই পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি লোক জড়িত। আর এই পণ্যের সিংহভাগ রফতানি হয় বৃহত্তর খুলনা অঞ্চল থেকে। ৬০-এর দশকে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। তবে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে এ অঞ্চলে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অভিযোগ ওঠে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় চিংড়িতে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, এরারুট, লোহা বা সিসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের পদার্থ মিশিয়ে এক ধরনের তরল পদার্থ তৈরি করে চিংড়িতে পুশ করে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রফতানি শিল্প। বিভিন্ন সময় বাতিল হচ্ছে শিপমেন্ট। এ অবস্থা পরিবর্তনে অনেক চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা এ অবস্থার পরিবর্তনে আরও কঠোর পদক্ষেপ চান। চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অপদ্রব্য পুশ করা চিংড়ি খেলে লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করা বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেও ফল মিলছে না। গত ২৮সেপ্টেম্বর কাজী সামসুর রহমান মৎস্য আড়টে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অপরাধে ৪০হাজার টাকা জরিমানা ও ৩হাজার চিংড়িতে কেরোসিন মিশিয়ে নদীতে ফেলে বিনষ্ট করা হয়। গত ৩০আগষ্ট মালতিয়া মোড়ে মিজানুর রহমানের ডিপুতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অপরাধে ৫হাজার টাকা জরিমানা ও ২০কেজি চিংড়িতে কেরোসিনের সাহায্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। গত ১আগষ্ট কাঁঠালতলা বাজারের ডিপো মালিক বকুল জোয়াদ্দারের ডিপোয় চিংড়ি ভিজিয়ে রাখার অপরাধে ২০হাজার টাকা জরিমানা এবং উক্ত ডিপোয় চিংড়ি বিক্রি করতে আসা ব্যবসায়ী স্বপন মন্ডলের চিংড়ি পরীক্ষা করে পুশ ও জেলি পুশ অপরাধে তাকে ৫হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। গত ২৭জুলাই আঁঠারমাইল বাজার মৎস্য আড়টে মাছে পুশ করার অপরাধে ৩জনকে জেল জরিমানা ও ১৫০কেজি মাছ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। গত ২৫জুলাই চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অপরাধে ১জনকে ৭দিনের জেল এবং আরেকজনকে ১৫দিনের জেল দেয়া ভ্রাম্যমান আদালত।
ডুমুরিয়া অঞ্চলে হাজার হাজার ডিপো রয়েছে। এখানকার কিছু ডিপোতে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করার অভিযোগ রয়েছে। কেজিতে ১০০-২০০ গ্রাম অপদ্রব্য পুশ করা হয়। এতে গ্রেড হিসেবে দাম বেড়ে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা অপদ্রব্য ঢুকিয়ে এসব মাছ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করেন। এসব মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ফেরত দিলে তা চলে যায় দিনাজপুর, পঞ্চগড়, বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গ, ঢাকার সাভার, সদরঘাট, কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। এতে স্থানীয় বাজারের ক্রেতারা ওইসব চিংড়ি ধরতে পারেন না। খেয়ে অসুস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারেন চিংড়িতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
উপজেলা মৎস্য সূত্রে আরও জানা যায়, বাংলাদেশের চিংড়ির অন্যতম বাজার ফ্রান্স, চীন, জাপান, ইতালি, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম, তাইওয়ান, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, মরিশাস, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, সাইপ্রাস ও ডোমিনিকান রিপাবলিক। চিংড়ি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এ অঞ্চলের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় পুশ করা চিংড়ি কম দামে কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করে থাকে। এ চিংড়ি রফতানি হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এতে প্রকৃত ও স্বচ্ছ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হন।
র্যাব-৬ এর পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোসতাক আহমদ বলেন, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা চিংড়ির জন্য খুবই বিখ্যাত। চিংড়ি বাংলাদেশের হোয়াইট গোল্ড হিসেবে পরিচিত। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা থেকে চিংড়ি দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহ করা হয় এবং বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তবে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় চিংড়িতে ক্ষতিকর অপদ্রব্য পুশ করে ওজন বাড়ান। তবে চিংড়িতে অপদ্রব্য মিশ্রণকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ডুমুরিয়ায় কয়েকটি অভিযানে আমরা সহযোগীতা করেছি।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ বন্ধে মৎস্য বিভাগ সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করছে। জনবল স্বল্পতার কারণে অভিযান নিয়মিত করা দুষ্কর হচ্ছে। তারপরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।