ইয়াস, আম্ফান এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই ফের ঘূর্নিঝড় অশনি’র চোখ রাঙানীতে আতংকিত সাতক্ষীরার উপকূলের মানুষ। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দুর্বল বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ি আগামী ১২ মে নাগাদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের খুলনা ও সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানতে পারে দক্ষিণ আন্দামান সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় অসনি। ঘূর্ণিঝড় অশনি’র আঘাতের শঙ্কায় তাই আতংকিত হয়ে পড়েছেন সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশাশুনির নদী ভাঙ্গন এলাকায় বসাবাসরত সাধারণ জনগণ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ২৪০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি ওই বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। কিন্তু এখন ওই ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। অর্থাভাবে দীর্ঘদিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ষাটের দশকে তৈরি ওই বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বাঁধগুলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নচাপ, লঘুচাপ, আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে লোকালয়ে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। দুর্বল এসব বেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। তাছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারেও বাঁধ উপচিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ফলে উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের উপকূলীয় তিন জেলার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কম এবং সেগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাছাড়া ওই বাঁধ দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। লবণাক্ত মাটি দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদ-নদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বেড়িবাঁধের মাটির বন্ডিং দুর্বল করে ফেলে। অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে বাঁধের মাটি ধুয়ে যায়। তাছাড়া বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণপানি তোলার কারণেও বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। যে কারনে যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে সৃষ্ট জলোচ্ছ¡াসে দুর্বল বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। বাস্তহারা হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। বসতবাড়ি হারিয়ে এলাকা ছেড়েছে অনেকে। ফলে স¤প্রতি সব চেয়ে বড় দুর্যোগ বলে মনে করা হয় নদী ভাঙন। এ নদী ভাঙন যেন উপকূলের মানুষের পিছু ছাড়ছে না। গত বছর আম্পান ঝড়ের পরে উপকূলের মানুষের যে পরিমান ক্ষয় ক্ষতি হয়ে সে গুলো কাটিয়ে উঠতে পারিনি এখনো। তার পর আবার বড় ধারণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার পূবাস শোনা যাচ্ছে। যদি এ অশনি নামের ঝড় এ এলাকা দিয়ে বয়ে যায় তাহলে উপকূলের মানুষের চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে।
উপকূলের মানুষের এধারনের দুর্যোগ থেকে পরিত্রান পাওয়ার একমাত্র উপায় হল টেকসই বেড়িবাঁধ নিমাণ করা। ইয়াসের পরে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে কাজ করলেও শুভংকরের ফাঁকি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারা প্রতিষ্ঠান। সঠিক তদারকির অভাবে পাউবো’র কোন কাজই ২৫ থেকে ৩০ শতাংমের বেশি হয় না। ফলে বার বার ভাঙে বেড়িবাঁধ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘূর্নিঝড় ইয়াসের পরে উপকূলের ১৪৯ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধের ২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে। ইয়াসের আগে বুলবুল ঝড়ের পরে ৪৩টা ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছিলো। ইয়াসের পরে ১৪টা পয়েন্টের কাজ হলেও এখনো ভালোভাবে কাজ শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। খুব দ্রুত যদি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো কাজ না করা যায় তাহলে সামনে যে অশনি নামের ঝড় আসছে তাতে উপকূলের মানুষ ফের তাদের সর্বস্ব হারাবে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানের মধ্যে আশাশুনির বিছট, মনিপুর , বাগালি, কোলা-ঘোলা, প্রতাপনগরের একাধিক পয়েন্ট, শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ ৩টি, বুড়িগোয়ালীনি ৫টি, গাবুরায় ৭টি, পদ্মপুকুর ৮টি, কাশিমাড়ী ১টি ও আটুলিয়ায় ১টি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
মুন্সীগঞ্জ বড় ভেটখালী গ্রামের সাইফুল ও রবি সরদার বলেন, আম্পানের সময় বড় ভেটখালির গোড়া ভাঙন দেখা দেয়। তারপরে সেটা ঠিক করা হয়নি। সামনে যে ঝড় আসছে সে ঝড়ের আগে যদি এ ভাঙনে কাজ করা না হয় তাহলে বাঁধ ভেঙে যাবে। ক্ষতি এলাকার হাজার হাজার বিঘার জমির মৎস্য সম্পদ। হরিনগর সিংহড়তলী গ্রামের বিশ্বজিত রায় বলেন, ইয়াসের পরে সিংহড়তলীর ভাঙন দেখা দেয় পানি উন্নয় বোডের্র লোকদের বলার পরে কাজ করিনি।
বুড়িগোয়ালীনির দূর্গাবাটি গ্রামের দিনেশ মন্ডল ও রতি রাণী বলেন, ইয়াসের সময় বাঁধ ভেঙে ঘর বাড়ি সব পানি উঠে গাছ পালা নষ্ট হয়ে গেছে। আবার শুনছি নতুন করে অশনি নামের ঝড় আসবে। আমাদের বেড়িবাঁধগুলো ঠিক করে দিলে আর পানিতে ভাসতাম না। এবার যদি পানি ঢোকে তাহলে কথায় যাব।
মুন্সীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান অসীম মৃধা বলেন, মুন্সীগঞ্জে ৩টি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমি বারবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বলার পরেও তারা কাজ করছে না। সামনে অশনি নামের যে ঝড় আসছে এই ঝড়ে অনেক জায়গা ভাঙার আশঙ্কা আছে।
জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ডালিম ঘরামী বলেন, আম্পানের রেশ কাটতে না কাটতে আবার অশনি নামের ঝড়ের আভাস শোনা যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা নদী বেষ্ঠিত। এখানে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সম্মূখিন হতে হয়। সরকারি মহল থেকে বারবার আশ্বাস প্রদান করলেও তা বাস্তবায়ন করতে দেখা যায় না। যে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে সব সময় আতঙ্কিত থাকি।
বুড়িগোয়ালীনি ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নে ৫টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট আছে। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আমজাদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইউনিয়নটা দ্বীপ ইউনিয়ন। এখানে ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি পয়েন্ট খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাড়াতাড়ি কাজ না করলে সামনে অশনির ঝড়ে আবার ভেঙে প্লাবিত হবে। এছাড়া আমাদের বড় সমস্যা হল বেড়িবাধের অংশ আশাশুনির মধ্যে। যে কারণে আমাদের দাবি সঠিক পূরুণ হয় না।
জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল বলেন, সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২ এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট গ্রামের প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুকিপূর্ন। নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেই এই বাঁধ চাপিয়ে ভিতরে পানি ঢুকছে। বাঁেধর পাশে বসবাসরত গ্রামবাসীরা সব সময় নদী ভাঙনের অতংকে থাকে। দ্রæত এই বাঁধ মেরামত করা না হলে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরো বাঁ ভেঙে যাবে। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বিছট গ্রামের শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধের পাশে টোঙ ঘর বেধে বসবাস করছে।
এ বিষয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের শ্যামনগর উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বলেন, আমরা অশনি ঝড়ের জন্য সম্পর্ণ প্রস্তুত রয়েছি। পর্যপ্ত জিআইও ব্যাগসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র রেডি আছে। অনেক জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে কাজ চলমান রয়েছে এবং অনেক কাজ হয়ে গেছে।