গোপালগঞ্জ, যশোর, খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাট ও পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ চলেছে যশোর-সাতক্ষীরা রোড ধরে। তাদের গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তান-ভারত বর্ডার পার হয়ে ভারতে যাওয়া। কেউ কেউ নদী পথে নৌকায় আর গরুর গাড়িতে। সোজা পথে সহজে যাওয়ার উপায় নেই। দুই তিন দিন পেটে ক্ষুদা আর পায়ে ফোসকা নিয়ে হেঁটেই চলেছে মানুষ। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু মৃত্যু তাদের পিছু ছাড়ে না। ঘর-বাড়ি, সবকিছু ফেলে ২-৩ দিন ধরে হেঁটে চলা শরণার্থীরা একটি স্থানে রাত কাটানোর জন্য অবস্থান নেয়। রাতের আহারের জন্য হাড়িতে রান্না ওঠায়। কিন্তু হঠাৎ পাশের গ্রামে মিলিটারী আসার খবরে, অভুক্ত মানুষগুলো আতঙ্ক নিয়ে সেই স্থানটি ত্যাগ করে। যুদ্ধ, গণহত্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে চলা মানুষগুলো মুখোমুখি হয় ঝাউডাঙ্গা গণহত্যার। মিলিটারীর দুটি গাড়ি আসে, হঠাৎ গাড়ি থামায় মতিয়ার রাজাকার। মিলিটারীরা গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় ট্রাইপডে মেশিনগান রেখে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে, কিছুক্ষণের মধ্যেই শত শত মানুষ তারা হত্যা করে। অনেকে ভয়ে গাছের আড়ালে, ঝোপে লুকিয়ে পড়ে।
কিন্তু ভর দুপুর বেলায় মিলিটারীদের এই গণহত্যা ঘটাতে কোনো বেগ পেতে হয় না। নির্মম এই গণহত্যা ঘটিয়ে নির্বিঘেœ গাড়ি নিয়ে চলে যায় মিলিটারীরা। আহত মানুষ চিৎকার করতে থাকে, লুকিয়ে থাকা মানুষ স্বজন হারানোর শোকে আর্তনাদ করতে থাকে। কিন্তু জীবনের মায়ায় তারাও শেষ পর্যন্ত স্বজনকে মাটিতে ফেলে রেখে বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা গণহত্যার ইতিহাস অবলম্বনে ‘পরিবেশ থিয়েটার নাটক ‘বর্ডার ‘৭১ মঙ্গলবার (২ নভেম্বর) রাতে সদা উপজেলার বাঁকাল বাজুয়াডাঙ্গা ফুটবল মাঠে মঞ্চায়িত হয়।
এসব দৃশ্য সরসারি সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠের বাঁকাল বাজুয়াডাঙ্গা মাঠে অবলোকন করেন কয়েক হাজার দর্শক। ঝাউডাঙ্গা গণহত্যা নিয়ে নির্মিত নাটকটি দেশে আবেগ আপ্লুত হয়ে অশ্রুশিক্ত হয়ে পড়ে দর্শকরা। এতে ২৫০ জন পেশাদার অপেশাদার অভিনয়শিল্পী অভিনয়ে অংশ নেন। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাতক্ষীরা-২ আসনের এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। বিশেষ অতিথি ছিলেন, এসডিএফ এর চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, ৩৩ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল মোহাম্মদ আল মাহমুদ, সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ আসাদুজ্জামান বাবু, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ আলী সুজন প্রমুখ। নাটকটি রচনা, পরিচালক ও নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন মোঃ মাজহারুল হোসেন তোকদার।
বক্তরা বলেন, আমরা শিকড় ভুলে গিয়েছিলাম। আজ এই নাটকের মাধ্যমে শিল্পীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা সকল প্রজন্মের মানুষের কাছে তুলে ধরলো। এই নাটকের মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য হলেও ‘৭১ স্মৃতি নাড়া দিয়েছে উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। এই প্রজন্মের মানুষের কাছে জানান দিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। এই ধরনের নাটক বেশি বেশি করা গেলে সাম্প্রদায়িক শক্তি আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। ৬৪ জেলায় বধ্যভূমিতে পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চায়নের অংশ হিসেবে সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা বধ্যভূমিতে বর্ডার ৭১ মঞ্চস্থ করার কথা থাকলেও সেখানে করা সম্ভব হয়নি, কারণ গণহত্যার স্থানটি এখন চিংড়ি ঘের এবং বধ্যভূমিটি অচিহ্নিত। তাই ঝাউডাঙ্গার মতো একটি স্থানকে নির্বাচন করার পর সেই স্থান ঘিরে সৃষ্টি হয় তিনটি দৃশ্য। অপেক্ষা, আতঙ্ক, ঝাউডাঙা গণহত্যা। নাটকের চরিত্র সংখ্যা সীমাবদ্ধ নেই। তিনটি দৃশ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত। কিন্তু প্রত্যেকটি দৃশ্য স্বতন্ত্র। ইতিহাস বলে শরণার্থীদের ঢল যখন বর্ডারের দিকে চলেছে তখন তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন পায়ে হেঁটে। বনে, জঙ্গলে, নদীর ধারে রাত্রি যাপন করে, ২-৩ দিন পায়ে হেঁটে, ফোসকা নিয়ে, চরম ক্ষুধা নিয়ে, মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে ছুটে চলা হিন্দুধর্মালম্বী নিম্নবিত্ত নিরন্ন এই মানুষগুলোর গন্তব্য বর্ডার। তাই এই নাটকের নাম বর্ডার ৭১। নাটকটি দেখে সকলে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, পরিবেশনাধর্মী শিল্পের অন্যতম জাতীয় প্রতিষ্ঠান। পরিবেশনা শিল্পের সকল মাধ্যমের উন্নয়ন, লালন, বিকাশ, উৎকর্ষসাধন এবং আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধন তৈরির ক্ষেত্রে একাডেমি নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে বেশকিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির বীর সন্তানদের যে ত্যাগ তা তুলে ধরতে আমাদের এই প্রয়াস।সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসকমোহাম্মদ হুমায়ূন কবির।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এবং জেলা শিল্পকলা একডেমির ব্যবস্থাপনায় ৬৪ জেলার ৬৫টি বধ্যভূমিতে গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার মঞ্চায়িত হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সাতক্ষীরা জেলার বাঁকাল বাজুয়ারডাঙ্গী ফুটবল মাঠে প্রথম প্রযোজনা মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হল ঝাউডাঙ্গা গণহত্যার ইতিহাস অবলম্বনে পরিবেশ থিয়েটার নাটক বর্ডার ‘৭১।
খুলনা গেজেট/এএ