খুলনা, বাংলাদেশ | ১৭ মাঘ, ১৪৩১ | ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  জামালপুরে ট্রাকচাপায় আটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত
  শাবান মাসের চাঁদ দেখা যায়নি, শবে বরাত ১৪ ফেব্রুয়ারি
  দুর্নী‌তি মামলায় খুলনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজানকে ৮ বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা করেছে ঢাকার বিশেষ আদালত

জীবনের গোল্ডেন টাইম ১৬ বছর জেল খেটে মায়ের কোলে বিডিআর সিপাহী জসিমউদ্দিন

একরামুল হোসেন লিপু

পিতা-মাতার ছোট সন্তান, তিন ভাই আর এক বোনের আদরের ছোট ভাই জসীমউদ্দীন। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দেয়াড়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকে খুবই মেধা জ্ঞানসম্পন্ন। এসএসসি পাস করার পর ২০০৫ সালের মার্চ মাসে বিডিআরের সিপাহী পদে চাকুরিতে যোগদান করেন। চাকুরিতে যোগদানের পর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন সিপাহী জসিমউদ্দিন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ভয়াবহ বিডিআর বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডে হাজারও বিডিআর জোয়ানদের মত তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। পিলখানায় স্থাপিত বিশেষ আদালত কর্তৃক বিচারের মাধ্যমে চাকুরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাঁকে। পরবর্তীতে সিভিল কেসের মাধ্যমে পিলখানা হত্যাকান্ড এবং বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৪ সালে হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও বিস্ফোরক মামলায় তাঁকে আটকে দেওয়া হয়। সেই বিস্ফোরক মামলায় জসীমউদ্দীনের জীবনের গোল্ডেন টাইম দীর্ঘ ১৬ বছর বন্দী জীবন থেকে বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। পরের দিন শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় মায়ের কোলে ফিরে আসেন।

২৮ জানুয়ারি খুলনা গেজেটের এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় জসীমউদ্দীন দীর্ঘ ১৬ বছর জেলখানায় কাটানো তাঁর বেদনাময়, দুর্বিষহ, যন্ত্রণাদায়ক, সীমাহীন কষ্টকর জীবনের বর্ণনা তুলে ধরেন।

জসিম উদ্দিন বলেন, “জীবনের যে গোল্ডেন টাইমটা ১৬ বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাড়ি এসে নতুন পৃথিবী ফিরে পেয়েছি। জেলের ভিতর থাকা অবস্থায় মামলা থেকে রেহাই পাবো কিনা? জীবিত অবস্থায় কখনও বেরোতে পারব কিনা সারাক্ষণ এই টেনশনে থাকতাম। জেলখানায় থাকা অবস্থায় বাবা আমার টেনশনে স্টক করে প্যারালাইজড হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় শয্যাশায়ী ছিল। হাঁটাচলা করতে পারত না। সারাক্ষণ আমার কথা জিজ্ঞেস করত। এক পর্যায়ে বাবা আমার শোকে মারা যান। মা-ও আমার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। জেলখানায় থাকা অবস্থায় বাবাকে দেখতে পারিনি। দীর্ঘ ১৬ বছরে মায়ের মুখ জেলখানার ভিতর থেকে মাত্র একবার দেখেছি। জেলখানার ভিতর কি যে দুর্বিষহ হতাশাজনক জীবন কাটিয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না।

জসীমউদ্দীন বলেন, ২০১৪ সালে পিলখানা হত্যাকান্ড মামলা থেকে খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় আমাকেসহ প্রায় সাড়ে ৮’শ বিডিআর সদস্যকে আটকে রাখে। তখন আমরা আইনি সহায়তা বা আইনি বিষয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি বা জামিনের জন্য চেষ্টা করি। কিন্তু তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার কোনভাবে আমাদের আইনি সহায়তা নিতে দেয়নি। আমাদের আইনজীবীদের মামলার বিষয়ে কোনও শুনানি করতে দেয়নি। আমরা মারাত্মক হতাশ হয়ে পড়ি এই ভেবে যে, আমরা আর কোনদিন জেলখানা থেকে বের হতে পারব না। জেলখানায় এক প্রকার মৃত জীবন যাপন করেছি। বেদনাময়, দুর্বিষহ, যন্ত্রণাদায়ক সীমাহীন কষ্টের ভিতর দিয়ে এক একটা দিন কাটিয়েছি। আমাদের অনেক সহকর্মী ভাইয়েরা বিনা চিকিৎসায় জেলখানায় মারা গেছে। অনেকে হতাশায় স্টক করেছে, প্যারালাইজড হয়ে গেছে, জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে দুর্বিসহ জীবন কাটিয়েছে। অনেককে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে দেখেছি। ১৬ বছর জেলখানার ভিতর দুর্বিষহ জীবন এবং কষ্টের কথা বলে শেষ করতে পারব না। ৫ আগস্ট নতুন স্বাধীনতার পর আমরা আলোর মুখ দেখি। আমাদের মনে আশা জাগে এবার আমরা জেল হতে বের হতে পারব। সেই আশায় আমরা ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের ছাত্র জনতা আমাদের সহায়তা করেছে। বিডিআর কল্যাণ পরিষদের আমাদের যে সকল ভাইয়েরা বাইরে ছিল তারা আমাদের মুক্তির জন্য, জামিনের জন্য অনেক আন্দোলন করেছে। ৫ আগস্টের পর অন্তবর্তী কালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৯ জানুয়ারি আমরা আমাদের উকিলের মাধ্যমে জামিনের আবেদন করি। ২১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার বিশেষ ট্রাইবুনাল-২ ‘র বিচারক মোঃ ইব্রাহিম মিয়ার আদালতে জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের নাম প্রকাশ করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) রাতে কাশিমপুর কারাগারের ২ নং জেলগেট থেকে জামিনে মুক্তি পাই। এরপর শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বাড়ি এসে পৌঁছায়।

আমার মা দীর্ঘদিন আমার টেনশনে থাকতে থাকতে বিছানায় পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। বাড়ি আসার পর মা আমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। এখন সে একটু ভালোর দিকে। দীর্ঘ ১৬ বছর জেলখানায় থাকায় আমার সংসার জীবনের কিছুই নেই। এখন সব শেষ হয়ে গেছে। দাম্পত্য জীবনও শুরু করতে পারি নাই। জীবনের যে গোল্ডেন টাইমটা সেই ১৬ বছর আমি জেলখানায় কাটিয়েছি। সরকারের কাছে আবেদন আমিসহ ১৮ হাজার ৫০০ ক্ষতিগ্রস্ত যারা বিডিআর ভাইয়েরা আছি, যারা তৎকালীন হাসিনা সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় জেল খেটে নিঃস্ব অবস্থায় আছি, তাদেরকে চাকুরিতে পুর্নবহাল করা হোক। আর যাদের চাকুরীর বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে তাদেরকে পেনশনের মাধ্যমে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা হোক। আমাদের নামে যে মিথ্যা মামলা আছে সে মামলাগুলো এ সরকার যেন প্রত্যাহার করে নেয়”।

এদিকে দীর্ঘ ১৬ বছর জেল খেটে জামিনে মুক্ত সিপাহী জসিমউদ্দিনকে খুলনা জেলা বিডিআর কল্যাণ পরিষদের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা প্রদান করা হয়। রবিবার (২৬ জানুয়ারি) বিকালে জসিম উদ্দিনকে অভ্যর্থনা জানাতে তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন খুলনা জেলা বিডিআর কল্যাণ পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক ল্যান্স নায়েক সহকারী মীর মোহাম্মদ মুসা, সহকারী সমন্বয়ক ল্যান্স নায়েক সিগন্যাল মহিন চৌধুরী, নায়েক সহকারী জাকির হোসেন, হাবিলদার দীপক, হাবিলদার সুজাউদ্দৌলা, সিপাহী মুন্না, সিপাহী ইকবাল, সিপাহী মহিদুল, সিপাহী শামীম, সিপাহী নাজিম, সিপাহী জলিল, সিপাহী রাসেল, সিপাহী হারুন অর রশিদ, সিপাহী জসিম ঢালী সিপাহী দেব কুমার, সিপাহী ইলিয়াস হোসেন প্রমুখ।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!