পিংকি রানী মন্ডলের বয়স এখন ১৮ বছর। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখলেও সমবয়সী আর দশটি মেয়ের মতো হেসে-খেলে চলতে পারে না সে। বলতে পারে না কথা। খেতেও পারে না নিজে। দিনভর বাড়ির বারান্দায় শুয়ে, বসে বা দোলনা চড়ে দিন কাটে তার। কিন্তু সব কিছু শুনতে পায় পিংকি, পারে বুঝতেও। এ যেন এক অদ্ভুত প্রতিবন্ধিতা। তার মায়া ভরা চাওনি দেখলে যে কারো জানতে ইচ্ছে হবে সেই অদ্ভুত প্রতিবন্ধিতার কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাতক্ষীরা উপকূলে সৃষ্ট নানা সংকট মানুষের জীবনকে যে এভাবেও থমকে দিতে পারে, তা অনেকটা অকল্পনীয়।
পিংকি রানী মন্ডলের সেই অদ্ভুত প্রতিবন্ধিতার কারণ জানালেন তার মা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরের কামালকাটি গ্রামের প্রতিমা মন্ডল।
তিনি জানান, উপকূলীয় এলাকায় সবসময় খাওয়ার পানির সংকট লেগেই থাকে। ভূ-গর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হওয়ায় বৃষ্টি ও পুকুরের পানিই খেতে হয় তাদের। তাও সংগ্রহ করতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে।
প্রতিমা মন্ডল বলেন, ‘পিংকি যখন সাত মাস পেটে, তখন খাওয়ার পানি আনতে গেলাম বাড়ি থেকে ২-৩ কিলোমিটার দূরের এক পুকুরে। যখন গেলাম তখন রৌদ ছেল। আসার সময় হঠাৎ ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ওয়াপদার রাস্তা কাদা হয়ে যায়। তখন কলস ভরে পানি নিয়ে আসার সময় পা পিছলে পড়ে যায়। ওই সময় পানি ভর্তি কলস পড়ে আমার পেটের উপর। এতেই হয়ে যায় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আমার পিংকি প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ও হওয়ার পর যখন বুঝতে পারি যে, ও স্বাভাবিক না, তখন থেকে প্রায় ছয়-সাত বছর ওকে সুস্থ করে তোলার জন্য অনেক চিকিৎসা করিছি, এমন কোনো জায়গানি যে যায়নি। এক পর্যায়ে ডাক্তাররা বলে ওকে আর ওষুধ খাওয়ায়ে লাভনি। ও এভাবেই বড় হবে।’
তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় পিংকির কথা বলতে বলতে কেদে ফেলেন প্রতিমা মন্ডল।
স্থানীয় প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণে কাজ করে পদ্মপুকুর ইউনিয়ন প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি।
এই সমিতির নির্বাহী পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমাগত লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙনে মিষ্টি পানির আধারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে স্থানীয় নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের উপর। এতে উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবন্ধিতাও বাড়ছে।
শুধুমাত্র পদ্মপুকুর ইউনিয়নেই ছয়শ’ প্রতিবন্ধী মানুষের তথ্য তাদের কাছে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, পদ্মপুকুর ইউনিয়ন প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির নাম সমিতি হলেও এটা মূলত একটা সংগঠন। আমাদের কোনো ফান্ড নেই বা কেউ ফান্ড দেয় না। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু কিছু উপকরণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। পেলে প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষের জন্য রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার পথও তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।
খুলনা গেজেট/এনএম