ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা ছুঁইছুঁই। মুরগির খুপি থেকে মোরগের কুকু-কুক ডাকারের আওয়াজ শুনতেই ঘুম ভেঙে যায়। রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ছড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। বাইরে বের হয়ে দেখা গেল প্রার্থণার জন্য মসজিদে মুসল্লিদের আনাগোনা। এ চিত্র খুলনার দাকোপ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সুতারখালী গ্রামের।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে লাল রঙের সূর্য একটু একটু করে রোদ ছড়াতে শুরু করেছে। শীতের সকালে দল বেধে কৃষক ছুটেছে খেতে। কারণ, খেতে তাঁদের সোনালী ফসল রয়েছে। নারীরাও সবজির খেতে পানি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিশোর-কিশোরীরা পড়াশোনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। রাস্তার পাশে নানান বয়সের মানুষ ছোট ছোট জটলা বেধে গল্পে মগ্ন।
খুব সকালে সুতারখালী গ্রামের হাসিনা বেগম নামের একজন গৃহিনী বলেন, সংসার গুছাতে ব্যস্ত সময় পার করছি। পরিবারের সদস্যদের জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে হচ্ছে। পরিবার প্রধান ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের কাজে তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাছাড়া শীতের বেলা আরও কত কাজ করতে হয়।
ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব হারিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রায় আড়াই বছর বেড়িবাঁধের ওপর পরিবার নিয়ে জীবন কাটান বাক্কার সরদার নামের এক ব্যক্তি। তিনি জানান, ওয়াপদার বাঁধ নির্মাণ হলে ভিটেয় ফিরে ঘরবাড়ি তৈরির পর নিজ আঙিনায় করা হয়েছে বড়সড় বাগান। বাক্কার বলছিলেন, আইলার পর এলাকায় অনেক সবুজায়ন ঘটেছে। লবণ পানির ঘেরের সময়কার রুক্ষতা আর নেই। প্রতিটি বাড়িতেই ফল-ফুল-সবজির খেত বাড়ছে। মানুষ নানা ফসল ফলাচ্ছে। আইলায় নানা ক্ষতির পরও ভালোটাও কম হয়নি।
২০০৯ সালের মে মাসের কোন একদিন প্রলয়ংকরী আইলার আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের যেসব এলাকা বিধ্বস্ত হয়েছিল তারমধ্যে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা প্রত্যন্ত এ এলাকা অন্যতম। এলাকাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩২ নম্বর পোল্ডারের আওতায়। বিধ্বস্ত ওই এলাকার বেশির ভাগ বাড়িঘর বিলীন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন লবণাক্ত পানি আটকে থাকায় গাছপালাও মরে যায়। তখন মানুষের ঠাঁই হয় বেড়িবাঁধে। সুতারখালী ইউনিয়ন ঘুরে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার এলাকায় নতুন করে যে সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে, তা প্রায় শেষের পথে। যে নলিয়ান নদীর বাঁধ ভেঙে ঘটনা ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছিল, সেই নদীর মুখ সম্প্রতি বন্ধ করা হয়েছে। তীর সংরক্ষণ করে ওই বাঁধ আরও শক্তিশালী করার দাবি আছে। বছর দুই ধরে ওই ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচুর পুকুর খনন করা হয়েছে। বাঁধ নির্মাণের জন্য চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাটি নেওয়ায় এলাকার অনেক মানুষের পুকুর খনন হয়ে গেছে। এতে স্বাদু পানির মাছ চাষ ব্যাপক বেড়েছে।
এলাকার বেড়িবাঁধে গাছ লাগানো হয়েছে, সেই গাছের পাহারাদারদের একজন লক্ষ্মী মণ্ডল। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এই এলাকার নারীরা এখন ঘরের বাইরের প্রচুর কাজ করছে। মাছ চাষ, কাঁকড়ার হ্যাচারি, কৃষি এবং কৃষিশ্রমিক হিসেবে সরাসরি কাজ করছে। পড়ালেখা করছে, বাল্যবিবাহ কমেছে। নারীদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতাও বেড়েছে। বিভিন্ন সভায় নারীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে।
কালাবগি গ্রামের আব্দুর রহমান গাজী নামের এক যুবক জানালেন, এলাকায় যুগের পর যুগ মাটির দেয়াল তুলে ঘর তৈরির প্রচলন ছিল। কিন্তু আইলায় নদীর বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে মাটির বাড়িগুলো ধসিয়ে দিয়েছিল। কষ্ট করে হলেও সেখানকার মানুষ পাকা বা আধাপাকা ঘর তৈরি করছে। আর যাঁরা পারছেন না, তাঁরা ঘরের খুঁটি দিচ্ছেন কংক্রিট দিয়ে।
সুতারখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক কালিপদ মণ্ডল বলেন, আইলার পর এলাকার চেহারা অনেকটা বদলে গেছে। বাঁধ হয়েছে। প্রায় বাড়িতে এখন গরু, বাছুর আছে। গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ এসেছে। পানির সংকট আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের প্রবণতা বেড়েছে। সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও নামমাত্র, কখনো বিনামূল্যে পানির ট্যাংকি দিচ্ছেন। শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। আইলার আগে উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নে অধিকাংশ কৃষিজমি একফসলি ছিল। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে লোনাপানির চিংড়ি চাষ হতো। পরিবেশ বিপর্যয়সহ বেশ কিছু কারণে ওই চাষ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর একমাত্র আমন ধানই ছিল ভরসা। তবে লবণ পানিতে দীর্ঘকাল চিংড়ি চাষের ফলে আমনের উৎপাদনও ভালো হতো না। এরপর বড় ধাক্কা আইলা। প্রায় আড়াই বছর মানুষ বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করতে বাধ্য হয়। জমিতেও একদানা ফসল কেউ করতে পারেনি। এখন সারা বছর বাড়ির আঙিনায় সবজির চাষ হচ্ছে।
সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির খুলনা গেজেটকে বলেন, আইলার পর পুরো এলাকা প্রায় আড়াই বছর পানিতে ডুবে ছিল। এখনো বেশকিছু সমস্যা আছে। তবে আইলার ১১ বছর পর এলাকায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সচেতনতা সবই বেড়েছে।
দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান খুলনা গেজেটকে বলেন, ওই এলাকায় আমন নির্ভরতা কমছে। মানুষ নানা ফসলের দিকে ঝুঁকছে। আইলা বিধ্বস্ত ওই অঞ্চলে বোরো, তরমুজ, আমনসহ নানা ফসলের সমারোহ।
খুলনা গেজেট / এআর