খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যমুনায় বিএনপির ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৮
  মার্কিন দূতাবাসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া
  ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশে এমন উন্মাদনা দেখতে চাই না : মির্জা ফখরুল

খুলনায় ১০ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অ‌ভি‌যোগ, তদ‌ন্তে নামছে দুদক

গেজেট ডেস্ক

দেশের বিভাগীয় শহর খুলনায় ১০ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দশটি প্রকল্পের মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের অফিসিয়াল প্রাক্কলিত দর টেন্ডারের আগেই ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে ঠিকাদারকে জানিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে।

প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- খুলনা শিশু হাসপাতাল সম্প্রসারণ, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন, জেলা শিল্প একাডেমি ভবন নির্মাণ প্রকল্প, জেলা সমাজ সেবা অফিস নির্মাণ প্রকল্প, ৩টি থানা ভবন নির্মাণ প্রকল্প, ৫০টি পরিত্যক্ত ও ২০টি কোয়ার্টার মেরামতকরণ এবং অফিস মেরামত সংক্রান্ত প্রকল্প।

অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে গত ৮ নভেম্বর অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানে অনেক অভিযোগেরই প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। যে কারণে অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ে অনুসন্ধানের সুপারিশ করতে যাচ্ছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট।

এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ শাখার উপপরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের খুলনা অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভবন ও কোয়ার্টার মেরামত দেখিয়ে কাজ না করে বিল উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানকালে দুদক টিম নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে অভিযোগের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এছাড়া অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন এবং রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। অভিযানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে শিগগিরই কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে এনফোর্সমেন্ট টিম।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়,গণপূর্ত অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাসসহ অন্যান্য প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ না করে নিজেরা অর্থ আত্মসাতসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি দুদকে জমা পড়ে।

কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এনফোর্সমেন্ট ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ৬ জুন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের উপপরিচালককে চিঠি দেয় দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল।

ওই সেলের চিঠিতে বলা হয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যান্য প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ না করে নিজেরা অর্থ আত্মসাৎ করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ সম্পর্কে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে এনফোর্সমেন্ট শাখায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে গণপূর্তের খুলনা জোনাল অফিস ও প্রকল্প এলাকায় অভিযান চালানো হয়।

দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়, গণপূর্ত, বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশল খালেকুজ্জামানসহ কর্মরত অন্যান্য প্রকৌশলীরা একটি সিন্ডিকেট গড়ে খুলনা গণপূর্ত বিভাগকে দীর্ঘদিন যাবত লুটপাট করে খাচ্ছে। তারা ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যের অর্থে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।

দুর্নীতির কয়েকটি ধরনের মধ্যে প্রধানটি হচ্ছে- টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই ঘুষের বিনিময়ে অফিসিয়াল প্রাক্কলিত দর পছন্দের ঠিকাদারকে জানিয়ে দেওয়া। আরেকটি ধরন হচ্ছে- চলমান কাজে নিম্নমানের নির্মাণসগ্রী ব্যবহার এবং সিডিউল মোতাবেক কাজ না করলেও ঘুষের বিনিময়ে নিম্নমানের কাজকে সঠিক দেখিয়ে বিল তুলে ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করা।

এছাড়া খুলনা মহানগরে গণপূর্ত বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভবন এবং কোয়ার্টার মেরামতের নামে কোনো কাজ না করে বিল উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাস বলেন, অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে ঢালাওভাবে অভিযোগ হয়েছে। অভিযোগটি ভুয়া। এর কোনো সত্যতা নেই। এখানে আমার অধীনে ছাড়াও প্রকল্প রয়েছে। সবগুলো প্রকল্পই আগের, অভিযোগের ভিত্তি নেই। দুদক কাগজপত্র চেয়েছে, সেগুলো দিয়েছি। বিষয়টি তারা যাচাই-বাছাই করে দেখবে।

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা প্রকল্পগুলো
খুলনা শিশু হাসপাতাল সম্প্রসারণে দুর্নীতি : খুলনা শিশু হাসপাতালের পাঁচতলা ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের জন্য ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডারটি ই-জিপি পদ্ধতিতে হওয়ায় অফিসিয়াল প্রাক্কলিত দর ঠিকাদারদের জানার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু শিশু হাসপাতালের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে ঘুষের বিনিময়ে প্রাক্কলিত মূল্য জানানো হয়েছে। এতে ওই টেন্ডারে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় সরকারের কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন : খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ বেড আইসোলেশন এবং ১০ বেড অইসিইউ-সিসিইউ ইউনিট নির্মাণের জন্য দুটি লটে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। ই-জিপি পদ্ধতিতে অফিসিয়াল প্রাক্কলিত মূল্য ঠিকাদারদের কখনও জানার সুযোগ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রেও টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে ঘুষের বিনিময়ে অফিসিয়াল প্রাক্কলিত মূল্য জানানো হয়েছে। এতে ওই টেন্ডারে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় সরকারের কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণ প্রকল্প : খুলনা বিভাগীয় ও জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণ কাজের জন্য ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই কাজ এক বছর আগে শুরু হয়েছে। বর্তমানে কাজটির ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। কাজে যেসব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে তাও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে নিম্নমানের ইট, বালু সিমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছেন। দরজা, জানালার জন্য মেহগনি কাঠ ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেখানে কমদামী কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্লোরে নিম্নমানের সি-গ্রেড টাইলস ব্যবহার হয়েছে। এছাড়া ঠিকাদার যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করেছে তার থেকে প্রায় দ্বিগুণ চলতি বিল প্রদান করা হয়েছে। সরেজমিনে কাজের স্থান পরিদর্শনসহ কাজের পরিমাণ ও প্রদান করা বিল যাচাই করলেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে।

জেলা সমাজ সেবা অফিস নির্মাণ প্রকল্প : জেলা সমাজ সেবা কার্যালয় ভবন নির্মাণ কাজের জন্য ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এ কাজ এক বছর আগে শুরু হয়েছে। বর্তমানে কাজের ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজে যেসব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে নিম্নমানের ইট, বালু সিমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছেন। দরজা, জানালার জন্য মেহগনি কাঠ ব্যবহার করার কথা থাকলেও সেখানে কমদামি কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফ্লোরে নিম্নমানের সি-গ্রেড টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ঠিকাদার যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করেছে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ চলতি বিল প্রদান করা হয়েছে। সরেজমিনে কাজের স্থান পরিদর্শনসহ কাজের পরিমাণ ও প্রদান করা বিল যাচাই করলেই প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে।

৩টি থানা ভবন নির্মাণ : খুলনার কয়রা থানা ভবন নির্মাণে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তেরখাদা থানা ভবন নির্মাণে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং দাকোপ থানা ভবন নির্মাণে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। তিনটি প্রকল্পের কাজ এক বছর আগে শুরু হয়েছে। বর্তমানে এসব কাজের প্রায় ৫৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. খালেকুজ্জামানসহ অন্যান্য প্রকৌশলী নির্মাণ কাজের সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু তাদের ম্যানেজ করেই তিনটি প্রকল্পে অনিয়ম হচ্ছে।

৫০টি পরিত্যক্ত ভবন মেরামতের অর্থ আত্মসাৎ : গণর্পূত-১ এর আওতায় খুলনায় প্রায় ৫০টি পরিত্যক্ত ভবন আছ। প্রতি বছর এসব ভবন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভবন প্রতি ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব ভবনে কোনো কাজ না করে বছরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়েছে।

২০টি কোয়ার্টার মেরামতের অর্থ আত্মসাৎ : গণর্পূত-১ এর আওতায় খুলনায় প্রায় ২০টি কোয়ার্টার রয়েছে। প্রতি বছর এসব ভবন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভবন প্রতি পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব ভবনে কোনো কাজ না করে বছরে এক থেকে দেড় কোটি টাকা ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করা হয়।

এছাড়া অফিস মেরামতের নামে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বলা হয়েছে, গণর্পূতের জোনাল অফিস, নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিস মেরামতের নামে এক কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে কাজ না করে এ পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এর পাশাপাশি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও রয়েছে।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!