জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ ধরে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সেই কোন্দল আরও তীব্র হয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে। দলের নেতা, দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীকে মৌন সমর্থন দিচ্ছেন। এ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
এ পরিস্থিতিতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে খুলনা বিভাগের ১০ জেলার নেতাদের বৈঠকে ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, বিভাগের সব জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপি এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে আগামী ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করাসহ বিরাজমান সাংগঠনিক সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, গত সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৪ আসনে আব্দুস সালাম মুর্শেদী দলের মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্ত্তজা রশিদী দারার পক্ষে ছিলেন রূপসা উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বাদশা। এ জন্য উপজেলা নির্বাচনে বাদশার বিকল্প প্রার্থী খুঁজছেন সালাম মুর্শেদী। এ নিয়ে সালাম মুর্শেদীর বক্তব্য, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েও প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন কামাল উদ্দিন বাদশা।
জেলা পরিষদ নির্বাচনেও তিনি চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদের বিরোধিতা করেছিলেন। এ কারণে নেতাকর্মীরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বাদশা বলেন, গত সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও অন্য কোনো নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে ছিলেন না।
এদিকে ফুলতলা উপজেলায় অস্বস্তিতে রয়েছেন নেতাকর্মীরা। তারা ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনকে ঘিরে বিভক্ত। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার অধিকারীর মতবিরোধ থাকায় তারা দলের ভেতরে নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন। অবশ্য দুই নেতাই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যশোরে নেতাকর্মী দুই ভাগে বিভক্ত
যশোরে উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়াচ্ছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। জেলার আটটি উপজেলাতেই দলের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত। যশোর-৩ আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী আবারও প্রার্থী হচ্ছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল ও যুব মহিলা লীগের নেত্রী ফাতেমা আনোয়ার।
এ ছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার গ্রুপের নেতা ও দলের সদর উপজেলা শাখার সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জুয়েল। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংঘাত এড়াতে তারা সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন।
কুষ্টিয়ায় উত্তেজনা
সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন দলের প্রার্থী আ কা ম সরওয়ার জাহান বাদশা। উপজেলা নির্বাচনে রেজাউল হক চৌধুরীর ভাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বুলবুল আহমেদ টোকেন চৌধুরী সম্ভাব্য প্রার্থী। সরওয়ার জাহান বাদশার অনুসারী আনিসুর রহমান ও এজাজ আহমেদ মামুনও প্রার্থী হতে পারেন। এ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ প্রকট রূপ নিয়েছে।
কুষ্টিয়া-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রউফের কাছে হেরেছেন দলীয় প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জ। দুই নেতাই উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী দিচ্ছেন। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে এখানে দু’জন খুন হয়েছেন। এ ব্যাপারে সেলিম আলতাফ জর্জ বলেন, এমপি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিধনে নেমেছেন আব্দুর রউফ। এই অভিযোগ অস্বীকার করে আব্দুর রউফ বলেন, কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
বাগেরহাটে অশান্তি লেগেই আছে
সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাগেরহাট-৩ আসনে অশান্তি লেগেই আছে। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলী ইজারাদারের বিরুদ্ধে দলের প্রার্থী হাবিবুন নাহার জয় পেলেও তাদের সমর্থক নেতাকর্মীর মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এই দুই নেতার অনুসারীরা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই আরও সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভূঁইয়া হেমায়েত উদ্দিন বলেছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শঙ্কা নেই।
সাতক্ষীরায় এক মঞ্চে আসছেন না নেতারা
গত জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরোজ আহমেদ স্বপন এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, জেলার কার্যনির্বাহী সদস্য সরদার মুজিব ও তালা উপজেলা শাখার সভাপতি শেখ নুরুল ইসলামের মধ্যে বনিবনা নেই। দলীয় কর্মসূচিতেও তারা এক মঞ্চে আসছেন না। তাদের অনুসারীরাও বিভক্ত। সাতক্ষীরা-২ আসনের সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সঙ্গে দলের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের বিরোধ এখন প্রকাশ্য। শ্যামনগর উপজেলার নেতাকর্মীরা সাবেক এমপি এস এম জগলুল হায়দার এবং বর্তমান এমপি এস এম আতাউল হকের নেতৃত্বে আলাদা বলয়ে অবস্থান করছেন। আশাশুনি উপজেলার চেয়ারম্যান এ বি এম মুস্তাকীম আবারও প্রার্থী হতে চান। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হচ্ছেন ডা. আ ফ ম রুহুল হক এমপির ঘনিষ্ঠজন শাহনেওয়াজ ডালিম। এ নিয়েও বিরোধ শুরু হয়েছে। অবশ্য গৃহদাহ মেটানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
মেহেরপুরে বিভক্তি
জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বিপক্ষে মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলায় আলাদা গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গত নির্বাচনে ফরহাদের কাছে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। গাংনী উপজেলার নেতাকর্মীরা এ এস এম নাজমুল হক সাগর এমপি, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদুজ্জামান খোকন ও মকবুল হোসেনের নেতৃত্বে বিভক্ত।
চুয়াডাঙ্গায় কমিটি অনুমোদন পাচ্ছে না
চুয়াডাঙ্গার নেতাকর্মীরা দলের জেলা সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দার ছেলুন ও সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদের নেতৃত্বে দুটি গ্রুপে বিভক্ত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন পাচ্ছে না বলে দাবি করেন দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম।
খুলনা গেজেট/হিমালয়