মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন এবং টেকসই মৎস্য আহরণের লক্ষ্যে সরকারের বেধে দেয়া তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা নৌকা-জাল নিয়ে ফের নদীতে মাছ শিকারে নেমেছে। পর্যাপ্ত জ্বালানী আর খাবার নিয়ে শত শত নৌকা এখন সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে। দীর্ঘ দিনের নিরবতা কাটিয়ে কাঙ্খিত মাছ পাওয়ায় খুশির আমেজ বিরাজ করছে জেলে, ট্রলার মালিক ও মৎস্য ব্যবসায়িদের মধ্যে। খুলনার বাজারগুলোতে মাছ সরবরাহ বেড়েছে। দামও কমেছে কিছুটা।
এদিকে একজনের নামের বিএলসি মহাজনরা অন্য নামে পাশ কেটে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ফলে অনেক প্রকৃত জেলে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না।
শুক্রবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার দেওলিয়া বাজার মৎস্য আড়তে যেয়ে দেখা গেছে, সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ড্রাম ড্রাম মাছ নিয়ে আসছে জেলে, ফুঁড়ি ও মহাজনেরা (কোম্পানী)। চাহিদামতো মাছ কিনে বড় আড়তে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন পাইকারি ব্যবসায়ি ও আড়তদাররা। আড়তের বিভিন্ন কমিশন এজেন্টে দেখা মেলে চিংড়ি, দাঁতনে, পারশি, জাভা, গাংড়া, চিত্রা, কৈখল, বাগদা, গলদাসহ হরেক রকমের মাছ। তবে দাঁতনি ও চিংড়ি সবচেয়ে বেশি। দাঁতনি ১২০ থেকে ৪১০ টাকা, চিংড়ি (চাকা) ২২০ থেকে ৪২০ টাকা, পারশি ৮০/৯০ টাকায় পাইকারি ব্যবসায়িদের কিনতে দেখা গেছে। বেশি দেখা মিলেছে ১৮০ থেকে ২২০ টাকা দরের দাঁতনি ও ৩৩০ থেকে ৩৬০ টাকা দরের চিংড়ি। তবে সবচেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে জাভা মাছ। ২ কেজি ওজনের একটি জাভা মাছের দাম সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। আরও জানা যায়, ঢাকা, খুলনা, চট্রগ্রামসহ দেশের ৪০ জেলায় এই আড়ত থেকে মাছ সরবরাহ করা হয়।
আড়তে কথা হয় মাছ বিক্রি করতে আসা হাফিজুল ইসলাম নামের এক মহাজনের সাথে। তিনি বলেন, তার আওতায় ১৫টি নৌকা এবছর সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে মাছ ধরতে গিয়েছে। আজ (শুক্রবার) পাঁচ শত কেজি মাছ পেয়েছে। ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, একটি গোনের ৬ দিন মাছ ধরা যায়। প্রতিটি নৌকায় সাধারণত ২ জন জেলে থাকে। প্রত্যেককে ওই ৬ দিনে ৫ হাজার টাকা ও খাবার দিতে হয়। এছাড়া বিএলসি পাশসহ বেশ কিছু খরচ রয়েছে। জেলেদের ধরা সমস্ত মাছ বিক্রি করে যা হয় সেটা সবই তার থাকে। তিনি প্রায় ২০ বছর এ পেশার সাথে জড়িত।
৪ নং কয়রা গ্রামের ব্যবসায়ি নূর মোহাম্মদ জানান, নদীতে আশানুরূপ মাছ ধরা পড়ছে। এতে তারা অনেক খুশি। তার আওতায় এবছর ৫টি বিএলসিতে ১৩ জন জেলে ৬ সেপ্টেম্বর মাছ ধরতে সুন্দরবনে যায়। প্রথম দিনে একশ’ কেজি মাছ পেলেও আজ পেয়েছে একশ’ ৩০ কেজি। বেশিরভাগ পেয়েছে দাঁতনি ও চিংড়ি মাছ। এবছর বেশ লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা তার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ি জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন শিবসা নদী ও পশুর নদে মাছ ধরেন তার জেলেরা। চরপাটার জালে মরা গোনে মাছ ধরা যায় না। প্রথম সপ্তাহে যারা নেমেছেন তারা বৈধ পন্থায় মাছ ধরেছেন বলে তিনি মনে করেন না। এজন্য তার জেলেরা এক সপ্তাহ পরে নদীতে নেমেছেন। ভালো মাছ পাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বিএলসি পাশের জটিলতায় অনেকে নদীতে যেতে পারছেন না। এছাড়া পাশের জন্য নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুন বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে।
৪ নং কয়রা গ্রামের জেলে সোহরাব গাজী, সাঈদ মোল্লা, আব্দুর রহমান জানান ও শচিন সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ধরার অনুমতি পাওয়ায় ভীষণ খুশি। জালে সন্তোষজনক মাছ ধরা পড়ছে ও জলদস্যুদের কোনো প্রকার ভয়ভীতি ছাড়ায় নিরাপদে-নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারছেন তারা।
ফারুক হোসেন নামে আরেক কোম্পানীর সত্বাধিকারী বলেন, দাঁতনি ও পারশি বেশি পাচ্ছেন তার জেলেরা, চিংড়িও পাচ্ছেন তবে কম। দিনে প্রায় ৩০/৩৫ কেজি মাছ পাচ্ছেন প্রতি বিএলসিতে। তবে সাইজে ছোট। তিনি আরও বলেন, চরপাটা জালে চিংড়ি মাছ কম হয়, ভেসাল জালে চিংড়ি মাছ বেশি ধরা পড়ে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ভেসাল জালের অনুমতি নেই।
এদিকে সুন্দরবন খুলে দেওয়ার প্রথম সাত দিন পর মাছ ধরে উপকূলে ফিরে এসেছেন অনেক জেলে। তারা জানান, গহিন বনে একেকটা জালে কয়েক মণ চিংড়ি পেয়েছেন। কয়রার মহারাজপুর এলাকার জেলে জামাল উদ্দিন বলেন, আশা করেছিলাম বেশি মাছ পাব। অবশেষে আশা পূরণ হয়েছে। সুন্দরবন খুলে দেওয়ার প্রথম দিনেই প্রচুর মাছ পেয়েছি। পরের কয়েক দিনও ভালো মাছ পেয়েছি।
মহারাজপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ আবু সাঈদ বলেন, পাশ নিয়ে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হলেও অধিকাংশই সমাধান হয়েছে। তবে এর জন্য ফরেস্ট অফিস দায়ী নয়, স্থানীয় অসাধু মহাজনদের কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তবে স্থানীয় জেলেরা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের অভিমত মহাজনেরা এক সাথে অনেকের বিএলসি নিয়ে ফরেস্ট অফিস থেকে অন্যের নামে পাশ করায় কিভাবে? যার বিএলসি তাকেই পাশ দেয়ার নিয়ম।
কয়রার দেওলিয়া মৎস্য আড়তের মেসার্স হোগলা ফিসের সত্বাধিকারী মো. ইনসান আলী বলেন, মাছের সাইজ প্রকার অনুযায়ী বিভিন্ন দামে আমরা কিনছি। ছোট-বড় সব সাইজের মাছ পাচ্ছি। তবে মাঝারি সাইজের বেশি। চিংড়ি ৩৩০ থেকে ৩৮০ টাকার সাইজ বেশি পাচ্ছি। দাঁতনি ১৮০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের চেয়ে দাম একটু কমেছে।
কয়রা কাসিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, তার আওতায় ৭০০ বিএলসির পাশ দেয়া হয়েছে। সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে সুন্দরবনে মাছের ঘনত্ব বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, যারা পাশ পারমিট পাচ্ছেন না, তারা মিথ্যা অভিযোগ করছেন। কোন অনিয়ম কিংবা ভোগান্তি হচ্ছে না।
প্রসঙ্গত, সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানসের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সালে সুন্দরবন বন বিভাগ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। যার অংশ হিসেবে ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকছে। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলেদের সুন্দরবনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন খাল ও নদীতে পুনরায় মাছ শিকারের অনুমতি দেওয়া হয়। চরপাটা জাল ও ভেপদি জাল দিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে নৌকা ও ট্রলারে মাছ ধরছেন জেলেরা। সুন্দরবনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫০টি নদী-খাল রয়েছে। অভয়ারণ্য ঘোষিত ৩০টি খাল এবং ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত খালে সারাবছরই মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। আর বাকি অংশের নদী-খাল ও জলাভূমিতে পারমিটধারী জেলেরা মৎস্য আহরণ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। মৎস্য আহরণের উপর সুন্দরবন উপকূলের প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে।
খুলনা গেজেট/ টি আই