অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার ভবদহ অঞ্চলে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মৎস্য ঘের। বেশির ভাগ ঘেরের পাড় তৈরি হয়েছে সরকারি রাস্তা ব্যবহার করে। স্বার্থান্বেষী এসব ঘের মালিকদের কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সরকারি রাস্তাগুলো ভাঙতে ভাঙতে ঘেরের মধ্যে বিলিন হতে চলেছে। এ রাস্তার পাশের গাছগুলো ঘেরের মধ্যে পড়ে মারা যাচ্ছে। পরে ঘের মালিকরা আবার সেগুলো কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে।
পথচারী ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঘের মালিকরা অপরিকল্পিতভাবে ঘের করে ব্যবসা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। যে কারণে এসব রাস্তায় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
মণিরামপুর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, মণিরামপুরে রাস্তা সংলগ্ন প্রায় ২শ’ মৎস্য ঘের রয়েছে। যে ঘেরগুলো রাস্তার ক্ষতি করছে।
অভয়নগর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চলিশিয়া, পায়রা ও সুন্দলীতে রাস্তা ক্ষতিকারক প্রায় ১ হাজার মৎস্য ঘের রয়েছে। এলাকাবাসি ও পথচারীদের অভিযোগ নওয়াপাড়া থেকে কালিবাড়ী রাস্তা, কালিবাড়ি থেকে মনোহরপুর বাজার ও নওয়াপাড়া থেকে মণিরামপুর রাস্তায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া, অভয়নগরের কোটা থেকে ডুমুরতলা রাস্তা, ডুমুরতলা থেকে আন্ধারাস্তা, কোটা থেকে বলারাবাদ রাস্তা, সুন্দলী থেকে আড়পাড়া রাস্তা, সুন্দলী থেকে সড়াডাঙ্গা, সুন্দলী থেকে আলীপুররাস্তা, সুন্দলী থেকে মশিয়াহাটী রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মনিরামপুরে মশিয়াহাটী থেকে পুড়াডাঙ্গা, আলীপুর প্রাইমারি থেকে গাবরডাঙ্গা রাস্তা, নেহালপুর বাজার থেকে পুড়াডাঙ্গা রাস্তা ঘেরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তা সংলগ্ন অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলায় কৃষ্ণ বৈরাগীর ঘেরের কারণে প্রায় ৪শ’ মিটার সরকারি রাস্তা বিলীন হচ্ছে। এ ঘেরের কোন বেড়িবাঁধ নেই। ঘেরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে গেছে। পাড় ভেঙ্গে রাস্তার অনেক গাছ ও বৈদ্যুতিক পোলহেলে পড়েছে। যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এ ব্যাপারে ঘের মালিক কৃষ্ণ বৈরাগীর ব্যবহৃত ০১৭৪৮০৮১৬৯৫ নং মোবাইলে বারবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। সরখোলায় ইকবালের ঘেরের কারণে রাস্তায় ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া মণিরমাপুর উপজেলার হাটগাছা গ্রামে পরেশ মন্ডলের ঘেরের কারণে প্রায় ১শ’ মিটার রাস্তায় ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার অনেক গাছ ঘেরের মধ্যে পড়ে মারা গেছে। পরেশমন্ডলের ঘেরে সামান্য কয়েকটি বাঁশ দিয়ে মুল রাস্তায় বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা কোন কাজে আসছে না।
ঘের মালিক পরেশমন্ডল বলেন, অন্যান্য ঘেরের তুলনায় আমার ঘেরে আমি বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করছি। ইশরামুল হকের ঘেরে গিয়ে দেখা যায়, তার ঘেরের কারণে প্রায় ২শ’ মিটার রাস্তা ও গাছ ভেঙে ভেঙে তার ঘেরের মধ্যে পড়েছে। যে গাছগুলো ঘেরের মধ্যে পড়েছে সে গাছগুলোকে মালিকরা কেটে নিয়ে গেছে। গাছের গোড়া তার প্রমান বহন করছে।
ঘের মালিক ইশরামুল হকের কাছে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একটি ঝামেলায় আছি, এই বলে তিনি রিং কেটে দেন। তিনি সাক্ষাৎ করে বলেন, ঘের শুকালে আমি বেড়িবাঁধ দেব। হারান ও অনিকের কারণে রাস্তায় বড় বড় ফাটল ধরেছে। সুজাতপুরে শ্যামল শিং এর রাস্তা সংলগ্ন ঘেরের কারণে রাস্তা ভেঙে ঘেরের মধ্যে পড়েছে।
ঘের মালিক শ্যামল শিং বলেন, রাস্তার সাথে আমার কোন ঘের নেই। অথচ হাটগাছা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধ নারায়ন চন্দ্র মল্লিক বলেন, সুজাতপুরে রাস্তা সংলগ্ন শ্যামল শিং এর ঘের রাস্তায় ভাঙন সৃষ্টি করছে। হাটগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর সামনে সনৎ বৈরাগীর ঘেরের ভাঙনের কারণে রাস্তার প্রস্থ অর্ধেক হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে হাটগাছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র রায় বলেন, ইতিপূর্বে ওই ঘেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। তদন্ত হয়েছে কিন্তু কোন দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বিশিষ্ট মৎস্য ব্যবসায়ী সঞ্জিত মন্ডল বলেন, সম্প্রতি নওয়াপাড়া থেকে আমি ট্রাকে করে সিমেন্ট নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু হাটগাছা নামক স্থানে পরেশ মন্ডল, হারান ও অনিকের ঘেরের মধ্যে আমার সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক পড়ে গিয়ে প্রায় ২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। ১৯৯৬ এর বিধি ২৮ অনুযায়ী নিজ ভূমির কম পক্ষে ১০ ফুট অভ্যন্তরে পুকুর বা জলাশয় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ সরকারি রাস্তার সীমানার কিনারা হতে কমপক্ষে ১০ ফুট দূরত্বে এবং ৪৫ ডিগ্রি ঢালেপাড়ে রেখে পুকুর/জলাশয় খনন করতে হবে। দন্ডবিধি, ১৮৬০এরধারা ৪৩১ অনুযায়ী সরকারি রাস্তার ক্ষতিসাধন ফৌজদারি দন্ডনীয় অপরাধ। এই আইনে ৫ বছরের কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় দন্ডেদন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
অভয়নগর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ফারুক হুসাইন বলেন, গত মাসে ঘের সংক্রান্ত মিটিং হয়েছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে মণিরামপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে আমরা সরকারি ক্ষতি কারণ প্রায় ২শ’ ঘেরের তালিকা তৈরি করেছি। আশাকরি এ মাসেই তাদের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা হবে।
কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখর চন্দ্র রায় বলেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি রাস্তা ক্ষতিকারক ঘেরের তালিকা ও ঘের মালিকের নাম ইউএনও অফিসে জমা দেব। এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবদহ অঞ্চলের রাস্তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নামজুল হুসেইন খান বলেন, ইঞ্জিনিয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম একটা রিপোর্ট করতে, যে সব ঘের রাস্তার ক্ষতি করছে সে সব ঘেরের তালিকা করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া আপনারা রিপোর্ট করে আমাকে একটি কপি দেবেন। ঘের মালিকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুলনা গেজেট/কেএম