বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে শ্যামনগরের আলম সর্দার

নিজস্ব প্রতি‌বেদক, সাতক্ষীরা

দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অনেকেই নতুন করে আবার সুন্দরবনের ডাকাত দলে নাম লিখিয়েছেন। ডাক পেয়েও সুন্দরবনে ডাকাত দলে গেলেন না সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের আলম সর্দার।

ফরসা চেহারা, মুখে দাড়ি, পরনে পোলো শার্ট আর ট্রাউজার। ইজিবাইকের চালকের আসনে বসা মানুষটাকে দেখে কে বলবে, একসময় দস্যুতা করতেন। পাশের চুনা নদীর ওপারে সুন্দরবন, যেখানে জীবনের অন্ধকার একটা অধ্যায় কেটেছে আলম সর্দারের। সেই দস্যু জীবন ছেড়ে এখন তিনি সংসার চালাচ্ছেন ইজিবাইক চালিয়ে। শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ থেকে নওয়াবেঁকী, কখনো বুড়িগোয়ালিনী কিংবা শ্যামনগর পর্যন্ত ইজিবাইক চালান আলম সর্দার।

পরিচিত অনেক আত্মসমর্পণকারীই আবার দস্যুতায় ফিরে গেছে। বারবার ফোন করেও দলে টানতে পারেনি তাকে। এই ইজিবাইক চালিয়েই এখন তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছে তার। এতেই শান্তি খুঁজে পেয়েছেন আলম সর্দার।

আলম সর্দার জানান, জন্মের তিন মাস পর মা বাবা আলাদা হয়ে যায়। বড় হয়েছি নানির কাছে। ছোট থেকেই মামার সঙ্গে সুন্দরবনে যেতাম। মাছ আর কাঁকড়া শিকার করতাম। লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ১৭ বছর বয়সে মামা মারা যায়। তখন নানির অনুরোধে বিয়েও করতে হলো। দু’বেলা খাওয়ার জোগাড় করাও কষ্টের ছিল। সেই সময় এলাকার যাঁরা ডাকাতি করতেন, তাঁরা তাকে লোভ দেখাত। বলত, চল অনেক টাকা হবে। অভাব ঘোচাতে ২০০৮ সালে ডাকাত দলে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য বুঝলেন, এই কাজ তাঁর না। এলাকায় পরিচিত জেলেদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতে হয়। এই কাজ করতে খুব কষ্ট লাগতো তার।

তিনি বলেন, “বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যু ঝুঁকি, এক ঘণ্টাও শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। ততদিনে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ডাকাত। বাড়ি ফেরার পথও বন্ধ। মাস ছয়েক পর সুন্দরবন ছেড়ে যশোরের বেনাপোলে চলে গেলাম। বাসা ভাড়া নিয়ে তুলা কেনাবেচার কাজ নিলাম। সিম পাল্টে ফেলে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চাইলাম।”

আলম সর্দার আরো বলেন, “সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ খুলনার এক অস্ত্র কারবারির ফোন। ফোন দিয়ে আবার সুন্দরবনে ফিরতে চাপ দিল। কিন্তু রাজি হলাম না। সেদিনই র‌্যাব তাকে ধরে ফেলল। অস্ত্রের খোঁজ জানতে চাইল। পরে মামলা দিয়ে জেলে পাঠাল। ১১ মাস জেল খেটে বের হলাম অসুস্থ শরীর। পেটে অপারেশনও করতে হলো, ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারতাম না। এরই মধ্যে খবর এল সুন্দরবনে দুই বাহিনীর বন্দুক যুদ্ধে পড়ে এক জেলে মারা গেছেন। সেই হত্যা মামলায় তার (আলম সর্দারের) নামও আসামির তালিকায় ঢুকে গেল। অথচ আমি তখন লোকালয়ে অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম। উপায়ান্তর না দেখে আবারও সুন্দরবনে পালাতে হলো।”

এদিকে আলম সরদারের নামে জারি হলো হুলিয়া। কয়েক বছর ডাকাত দল চালানোর পর ২০১৫ সালে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে থাকতেই খবর পান বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছে সরকার। সুন্দরবনের কুখ্যাত মাস্টার বাহিনী সে সময় আত্মসমর্পণ করে। আলমের মনেও জন্ম নিল স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা। আবারও সুন্দরবনে এসে তাঁর সঙ্গে যাঁরা দস্যুতায় নাম লিখিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মসমর্পণে উৎসাহ দিলেন। ২০১৬ সালের ৮ মে তাঁরা ১৪ জন ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার আটটি বিভিন্ন ধরনের গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। পুনর্বাসনের জন্য সরকারের দেওয়া এক লাখ টাকায় কেনেন পুরোনো ইজিবাইক। সেই দিন থেকে শুরু তাঁর নতুন জীবন।

সম্প্রতি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। আলম সর্দারের চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। বললেন, “অতীতের ভুল জীবনে আর ফিরতে চাই না। এই ইজিবাইকেই আমার সংসারের ভরসা, এই পথেই আমার শান্তি।”

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন