১৯৪১ সালের ৫ জুলাই তার জন্ম। পিতার নাম এমদাদুল হক এবং মাতার নাম শামসুন নাহার। খুলনার ফুলতলা উপজেলার পাটগ্রাম কসবা তার পৈতৃক নিবাস। ছয় ভাই ও চার বোনের; তিনি ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। এই শহীদ সাংবাদিকের বড় মেয়ে সৈয়দা নাহিদ শাহীন, বড় ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল এবং ছোট ছেলে সৈয়দ মুস্তফা নাজমুল। শৈশবে বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়ায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিএ অনার্স এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের পত্রিকা তিস্তা সম্পাদনা করেন। অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সংস্কৃতি বিষয়ে ডন, পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা টাইমস, ওয়েভ এবং ইউনিটি ইত্যাদি পত্রিকা প্রবন্ধ লিখতেন।
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান পণ্ড করা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে সরকার তাকে সি এস পিতে যোগদান করার সুযোগ দেয়নি। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) প্রত্যাহার হয় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই মামলা থেকে মুক্ত হবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬৯ সালের অক্টোবর মাসে যখন ইউরোপ ও লন্ডন সফরে যান, তখন তার একান্ত সচিব হিসেবে সৈয়দ নজমুল হককে নিয়ে যান (বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রকাশনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সাংবাদিক)। তিনি বিদেশে সেই সময় ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর সাথি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্নেহের নিদর্শন স্বরূপ সৈয়দ নজমুল হককে একটি পাইপ উপহার দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা সাংবাদিক কে জি মুস্তফা লিখেছেন, ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে করাচীতে ওয়েজ বোর্ডের সভা শেষে ঢাকায় ফিরছিলাম। বিমানে উঠেই দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও সাংবাদিক নাজমুল হক। আমাকে দেখেই নাজমুল হক হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। আমিও তাদের সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে দারুণভাবে খুশি।
বিদেশ সফরকালে বিবিসি ও লন্ডন টেলিভিশনে অংশগ্রহণ করে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ ও প্রচার করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবার আগে বঙ্গবন্ধু যথাযথ রিপোর্ট করার জন্য নাজমুলকে ডেকে পাঠান। পি আই বি’র প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে নাজমুল হক চলে যান। ঐতিহাসিক ভাষণের যথাযথ রিপোর্ট করে ৭ মার্চ রাতে বাসায় ফেরেন। ঐ সময় তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নজরে পড়ে যান। যুদ্ধ চলাকালীন তার লেখনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে একমত পোষণ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দেন এবং দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি বিদেশি সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নাজমুল হক পিপিআই এর চিফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সামরিক গোয়েন্দাদের এড়িয়ে হোটেল ইন্টারকনে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য’র তথ্য পৌঁছে দিতেন। নানা অভিযোগে তাকে ঢাকা থেকে ৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে পাঠানো হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের আটকে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাকে উৎপীড়ন করে। তিনি সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। ২০ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে নজরবন্দি করে রাখে। নাজমুল হক যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন আমাদের অনেক বাঙালিই তা করতে পারেননি। তারা প্রাণের ভয়ে বঙ্গবন্দুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু নাজমুল তা করেননি।
তিনি স্ত্রী সুলতানাকে বলতেন, দেশ স্বাধীন হবেই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারব না। স্বাধীন বাংলায় আমি আমার ছেলেমেয়ের কাছে দালাল, বিশ্বাসঘাতক পিতা বলে পরিচিতি হতে পারব না। পুনরায় ১৯ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গোপন বিচারে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অকথ্য নির্যাতন করে। তা সত্ত্বেও তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেননি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত চারটার দিকে তিনি পুরানা পল্টনের বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তান বাহিনী তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেই সময় পাশের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ অপহরণকারীদের প্রত্যক্ষ ও নির্ণয় করেন। পরিবার শত খোঁজাখুঁজির পরও শহিদ নাজমুল হকের সন্ধান পায়নি। স্বাধীনতার পর তার বড় ভাই ও স্ত্রী অপহরণকারীদের শনাক্ত করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর দুই জল্লাদ লন্ডনে পালিয়ে যায়। তার মধ্যে একজন হচ্ছে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাদের দু’জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার আদেশ দিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান আমেরিকায় এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীন ইংল্যান্ডে পালিয়ে আছে।
খুলনা গেজেট/এনএম

