আজ ১০ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলার দুই সূর্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ রুহুল আমীন ও বীরবিক্রম মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ’র ৫৪ তম শাহাদাতবার্ষিকী। দেশ স্বাধীনের মাত্র ৬ দিন আগে ১৯৭১ সালের এ দিনে খুলনাকে শত্রুমুক্ত করার অঙ্গিকার নিয়ে রণতরী পলাশ, পদ্মা ও গানবোট পানভেল যাত্রা করে। রূপসা ঘাট ও শিপইয়ার্ডের মাঝামাঝি বিমানের নিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণে ‘পলাশে’ থাকা স্বাধীন বাংলার এ দুই সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। পরে স্থানীয়রা তাদের মৃতদেহ রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে সমাহিত করে।
জাহাজ তিনটি ওই স্থানে পৌঁছালে আকাশে থাকা বিমান তিনটি নিচে নেমে এসে আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথম গোলা এসে পড়ে পদ্মায়। এতে পদ্মার ইঞ্জিন বিধ্বস্ত হয়ে যায়। হতাহত হয় অনেক নাবিক। পদ্মার পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হয়ে সবাইকে বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে বলে তিনি ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। এদিকে বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণে পলাশের ইঞ্জিনরুমও ধ্বংস হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় পলাশকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান অসীম সাহসী রুহুল আমিন। এসময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায়। গোলার আঘাতে রুহুল আমিনের ডান হাত সম্পূর্ণ উড়ে যায়। অবশেষে পলাশের ধ্বংসাবশেষ পিছনে ফেলে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। ভাসতে ভাসতে পূর্ব তীরে আসেন। সেখানে অবস্থান করা রাজাকাররা আহত এ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। তার বিকৃত মৃতদেহ বেশ কিছুদিন সেখানে পড়ে থাকার পর স্থানীয় জনসাধারণ রুহুল আমিন, মহিবুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধাকে রূপসা নদীর পাড়ে দাফন করে।
শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি বিলুপ্ত করার চক্রান্ত রোধে ১৯৯৭ সালে রূপসার সাংবাদিক সমাজ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের। তৎকালিন উদ্যোক্তা সাংবাদিকরা হলেন, দৈনিক খুলনা গেজেটের সহকারী সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন, সাব এডিটর এস এম মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের খুলনা ব্যুরো প্রধান সামছুজ্জামান শাহীন ও গণমাধ্যম কর্মী তরুন চক্রবর্তী বিষ্ণু। ওই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খুলনা বিশ্বিবদ্যালয়ের আর্কিটেক বিভাগের ডিজাইন ও কেডিএর অর্থায়নে এ দুই শহিদ বীরের সমাধি মাজারে রূপান্তরিত হয়। এরপর থেকে রূপসা প্রেসক্লাব ধারাবাহিকভাবে এ দুই সূর্য সন্তানের স্মরণে অনুষ্ঠান করে আসছে। প্রতি বছরের ন্যায় রূপসা প্রেসক্লাব এবছরও এ দুই বীরের স্মরণে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
কর্মসূচির মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রেসক্লাবের সামনে ক্রীড়া চত্বরে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে ৮ দলীয় ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া আজ বুধবার সকাল ৯টায় পূর্ব রূপসাস্থ মাজার প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, বেলা ৩টায় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে স্মরণ সভা ও দোয়া অনুষ্ঠান এবং রাত ১০টায় ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্টে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ।
এছাড়া সকালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বানৌজা তিতুমীর, রূপসা উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাজার প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে।
প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাঘচাঁপড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারী ও মায়ের নাম জোলেখা খাতুন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বাড়িতে গিয়ে ছাত্র, যুবক ও সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর লোকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেন। এর কিছুদিন পর ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তিনি।
অপরদিকে বীরবিক্রম মোহাম্মদ মহিবুল্লাহ ১৯৪৪ সালের ৩১ আগস্ট চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার শাহেদাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোঃ সুজাত আলী ও মায়ের নাম রফিকাতুন্নেছা। তিনি ১৯৬২ সালে নৌবাহিনীতে যোগদান এবং একই সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তার গ্রামের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর রুহুল আমীনকে বীরশ্রেষ্ঠ ও মহিবুল্লাহকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
খুলনা গেজেট/এনএম

