মঙ্গলবার । ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ । ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২
সওজ’র দেড় সহস্রাধিক কর্মচারীর মানবেতর জীবন

৩০ দিন কাজ করে বেতন পায় ২৮ দিনের, নেই বাড়তি কোনো সুবিধা

নিজস্ব প্রতি‌বেদক

‘ঘরে অসুস্থ বাবা। মাসে ওষুধে তাঁর পিছনে ব্যয় আট হাজার টাকা। দুই ছেলে মেয়ে, ভাইপোর পড়াশুনার খরচ। ৯ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ দিতে হচ্ছে। অথচ সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একমাত্র আমি। প্রতিদিন ৫৫০ টাকা হাজিরা থাকলেও ৩০ দিন কাজ করে বেতন পাই ২৮ দিনে ১৫ হাজার ৪০০ টাকা। সামান্য বেতনে এমনিতেই সংসার চালাতে হিমশিম খায়। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তার উপর চার মাস বেতন বন্ধ। পরিবারে পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে আছি। ধার-দেনা করার সব পথ বন্ধ। দোকানদাররা বাকি দিচ্ছে না। কোনো মতে খেয়ে, না খেয়ে, বেঁচে আছি। ২৭ বছর চাকরি করেও নিয়মিত হতে পারলাম না। সাময়িক শ্রমিক হিসাবে আমাদের ট্রিট করা হয়। ঈদের আগে সকাল সরকারি বেসরকারি কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাই। ব্যতিক্রম শুধু আমরা।’

চারমাস বেতন না পেয়ে এভাবে আক্ষেপ করে কষ্টের কথা বলছিলেন খুলনা সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ)’র মাস্টাররোল কর্মচারী হেভি ইকুপমেন্ট চালক ফিরোজ আহমেদ গাজী। তিনি বলেন, “১৯৯৮ সালে দু’হাজার টাকা মাসিক বেতনে মাস্টাররোলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করি। ২০০২ সালে তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী খায়রুজ্জামান স্যার অন্যত্র বদলি হওয়ার পর হঠাৎ বেতন বন্ধ হয়ে যায়। বেতন ছাড়া ডিউটি করি ৩-৪ বছর। অফিসের স্যারেরা ব্যক্তিগত পকেট থেকে কিছু টাকা পয়সা দিতো, সেটা দিয়ে কোনোমতে চলতাম। এরপর ২০০৮ সাল থেকে দৈনিক হাজিরা ১২০ টাকা, পাঁচ বছর পর ২০১৩ সালে ১০ টাকা হাজিরা বৃদ্ধি করে ১৩০ টাকা, ২০১৪ সালে ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, তিন বছর পর ২০১৭ সালে ২২৫ টাকা দৈনিক হাজিরা হিসেবে বেতন পেতাম। তাও ২/৩ মাস পর। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ২০১৯ সাল থেকে দৈনিক হাজিরা ৫৫০ টাকা ধার্য করা হয়। তাও ২৮ দিন হিসেবে।”

আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারী হিসেবে ড্রাইভার পদে ২০২০ সাল থেকে খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগে কাজ শুরু করেন ৩৬ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ ফরাজী। টানা চার বছর বিনা বেতনে চাকরি করেছেন।

খুলনা গেজেটকে তিনি বলেন, “বেতন বন্ধ থাকাকালীন অফিসের স্যারদের আর্থিক সহায়তায় কোনোমতে সংসার চালিয়েছি। গত বছর থেকে মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, তিন ছেলে-মেয়ে, ছোট ভাই মিলে ৯ সদস্যের সংসার। বেতন ছাড়া বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সাত হাজার টাকা বেতনে ৯ সদস্যের সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাই। তার উপর চারমাস বেতন বন্ধ। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।”

সওজ’র নির্বাহী প্রকৌশলী দপ্তরের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মেহেদী হাসান খুলনা গেজেটকে বলেন, “পাঁচ বছর আগে মাস্টাররোল কর্মচারী হিসেবে ৯ হাজার ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করি। সর্বশেষ ৫৫০ টাকা দৈনিক হাজিরা হিসেবে ২৮ দিনে বেতন পাই ১৫ হাজার ৪০০ টাকা। আমাদের সবার দাবি ৩০ দিনের হাজিরা হিসেবে বেতন দেওয়া হোক। তবে দুঃখের বিষয় চলতি বছরে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বেতন কিছুটা বৃদ্ধি করা হলেও হাজিরা কমিয়ে ২২ দিন করা হয়েছে। আমরা এর অবসান চাই।”

শুধু ফিরোজ আহমেদ গাজী, আব্দুল্লাহ ফরাজী আর মেহেদী হাসান নয়। সারা দেশে সড়ক ও জনপথ বিভাগে তাদের মতো দেড় সহস্রাধিক মাস্টাররোল ও আউটসোর্সিংয়ের অস্থায়ী কর্মচারী চার মাস বেতন না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর মধ্যে মাস্টাররোলে কর্মরত রয়েছেন ৪০ জন এবং আউটসোর্সিংয়ে রয়েছেন ৮৭ জন কর্মচারী।

খুলনা সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ)’র নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তানিমুল হক বলেন, “জনবল সংকটের কারণে মাস্টাররোল এবং আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের দিয়ে আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হয়। নির্দিষ্ট একটা কোডের মাধ্যমে তাদের বেতন দেওয়া হতো। সেটি পরিবর্তন হওয়ায় কিছুটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রণালয় মতামত চেয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হবে।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন