অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়রা উপজেলার ৪০ জনকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এ তালিকা জেলা কামান্ডে জমা দিয়েছে। তালিকা প্রস্তুত হওয়ায় খুলনা সফররত মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা সন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ণয়ে দীর্ঘদিন ধরে দফায় ধফায় যাচাই বাছাই চলে। এ উপজেলায় ১৬৮ জন ভাতা গ্রহণ করছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিমাসে দু’হাজার টাকা করে ভাতা চালু করে। পরবর্তীতে মাসে ২০ হাজার টাকা, প্রত্যেক ঈদে ১০ হাজার টাকা করে উৎসব বোনাস, ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষের বোনাস, ভারতে চিকিৎসা সুবিধা, রাষ্ট্রীয় খরচে হজ্ব যাত্রা, এলজিইডির তত্ত্বাবধায়নে দু’কক্ষের বীর নিবাস পাওয়া, জেলা সদরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ এবং ব্যাংক ঋণ নেওয়ার সুযোগ চালু হয়। মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীরা চাকুরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিশেষ সুযোগ ছিল। মুলত এই আশায় নানা ধরনের কাগজপত্র তৈরি করে অসত্য তথ্য দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সনদ গ্রহণ করাই ছিল লক্ষ্য।
জনশ্রুতি রয়েছে, মসজিদকুড় গ্রামের আব্দুর রহমান সানা এবং মরহুম সাংবাদিক জিএম মতিউর রহমান ৯৬ পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। অনেকের অভিযোগ তারা নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছে। সংসদের আজকের কর্মকর্তাদের দাবি, উল্লিখিতদের কাছে এখনও প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদ এবং একাত্তরে জমা দেওয়া অস্ত্রের প্রমাণাদি সংরক্ষিত রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের সুপারিশ রয়েছে, যুদ্ধকালীন কমান্ডার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মরহুম জালাল ঢালী ও গোবিন্দপুর গ্রামের অ্যাডভোকেট জিএম কেরামত আলীর। ৯৬ পরবর্তী আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য মরহুম শেখ মোঃ নুরুল হক ও আকতারুজ্জামান বাবু ছিলেন এ বিষয়ে উদার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শণে বিশ্বাসী হলেই নির্দ্বিধায় সনদের জন্য সুপারিশ করতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং গাবুরার পাশের্^মারী সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চে মুক্তিযোদ্ধাদের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য তৎকালীন পাইকগাছার (আজকের কয়রা) বামিয়াতে সোহরাওয়ার্দি ক্যাম্প ও ৪ নং কয়রার ঝিলেঘাটায় নারায়ণ ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। এসব স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার অ্যাডভোকেট স ম বাবর আলী। উল্লিখিত দু’টি ক্যাম্পে ও তার আসে পাশের এলাকায় উল্লিখিত ৪০ জন তথাকথিত সনদধারীর কোনোরকম সম্পৃক্ততা ছিল না। যুদ্ধ পরবর্তী মুজিববাহিনী ঢাকা স্টেডিয়ামে এবং মুক্তিবাহিনী ফুলতলায় অস্ত্র জমা দিয়ে সনদ গ্রহণ করে।
জেলা কমান্ডের কাছে পাঠানো তালিকার অমুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন, নাকশা গ্রামের আকছেদ আলী, খোদাবক্স সানা, মোফাজ্জেল হোসেন, নূর আলী সরদার, আব্দুল আজিজ খাঁ, আবু বক্কর সিদ্দিকী, প্রফেসর অসিত বরণ বিশ্বাস, ফতেকাটি গ্রামের মৃত আব্দুস সবুর সানা, আব্দুল মালেক গাজী, আব্দুর রাজ্জাক সানা, খেওনা গ্রামের ফজলুল হক মোড়ল, দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামের মাধব কুমার মন্ডল, আব্দুল গফুর সরদার, উত্তর বেদকাশী গ্রামের এসএম আশরাফ হোসেন মাস্টার, মাধব চন্দ্র গাইন, হাতিয়ারডাঙ্গা গ্রামের নির্মল চন্দ্র মন্ডল, মদিনাবাদ গ্রামের ইমতাজ উদ্দীন সরদার, মহারাজপুর গ্রামের প্রভাষক লুৎফর রহমান গাজী, মরহুম আব্দুল গফুর গাজী, বাগালী গ্রামের এসএম আব্দুল গফ্ফার, ১ নং কয়রা গ্রামের আব্দুল গফুর গাজী, আব্দুর রশিদ, কয়রা গ্রামের মেছের আলী সরদার, ৩ নং কয়রা গ্রামের বট কৃষ্ণ ঢালী, অর্জুনপুর গ্রামের আবুল হোসেন গাজী, কালনা গ্রামের আফতাব উদ্দিন হাওলাদার, বামিয়া গ্রামের ছফেদ আলী গাজী, জিএম আব্দুল হাকিম, এনসান আলী, শিমুলিয়ারআইট গ্রামের লুৎফর রহমান মোল্লা, মসজিদকুড় আব্দুর রহমান সানা, জয়পুর গ্রামের সুরত আলী মোড়ল, কাটাখালী গ্রামের ইউসুফ আলী সরদার, গুপিয়ার বেড় গ্রামের আব্দুল জব্বার, কুশুডাঙ্গা গ্রামের আনোয়ার হোসেন গাজী, লালুয়া বাগালী গ্রামের মৃত আব্দুল খালেক গাজী, জোড়শিং গ্রামের জিএম ফজর আলী, শ্যামখালী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ঢালী, উত্তর মদিনাবাদ গ্রামের এমদাদ আলী সরদার ও হড্ডে গ্রামের আসাদুল সানা।
৫ আগস্ট পরবর্তী উপজেলা কমান্ড গেল বছরের অক্টোবরে গঠিত খুলনা জেলা কমান্ডের কাছে উল্লিখিত তালিকা পাঠায়। গত ৩০ জুন দুপুরে কয়রা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় অমুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে আলোচনা হয়। তালিকাভুক্ত অমুক্তিযোদ্ধাদের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত জেলা আহ্বায়ক মোঃ আবু জাফর অমুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানান। মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার না দেওয়ার জন্য উপজেলা ও থানা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
উপজেলা সংসদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এমদাদুল হক গাজী এ প্রসঙ্গ নিয়ে উল্লেখ করেন, অমুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়েছে। তাদের তালিকা জেলা কামান্ডে জমা দেওয়া হয়। এ নিয়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। বিভিন্ন সময়ের যাচাইবাছাই কমিটিতে সংসদ সদস্যদের সুপারিশে অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম নানাভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তিনি গর্বের সাথে বলেন, দীর্ঘদিন পর সত্যিকারের যোদ্ধাদের তালিকা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর জালিয়াতি স্পষ্ট হবে।
এই তালিকাভুক্ত একজন মসজিদকুড় গ্রামের বেলায়েত হোসেন সানার পুত্র আব্দুর রহমান সানা। তিনি বিভিন্ন সময়ে উপজেলা পর্যায়ের কামান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। সব সময় সন্দেহের তীর তার দিকে ছিল। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। আমাদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। নানা জনকে সন্তুষ্ট করে বিভিন্ন সময়ে যাচাই বাছাই কমিটিতে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।
প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি বলেন, পট পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। একাত্তরের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিএলএফ’র হয়ে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেন। দাবি করেন যুদ্ধকালীন কামন্ডার ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু ও শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু। গল্লামারীস্থ বেতার কেন্দ্র, বারোআড়িয়া, পাইকগাছা হাইস্কুল, কপিলমুনি, চাপড়া, গোয়ালডাঙ্গা, সাতক্ষীরার ভাতশালা, কেয়ারগাতিসহ মোট ১৪ যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিববাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার স ম বাবর আলী রচিত জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতা দুর্জয় অভিযানে তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে দাবি করেন।
উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর স্থানীয় সার্কিট হাউজে জেলা ও নগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীর প্রতীক এর সৌজন্য সাক্ষাৎকালে অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। অন্যান্য উপজেলায় এ কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
খুলনা গেজেট/এনএম

