বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

সুন্দরবনে পর্যটক টানতে ২০ বছরের মহাপরিকল্পনা

আল মামুন

বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে একটি ২০ বছর মেয়াদী (২০২৫-২০৪৫) সুন্দরবন ইকোট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা)। এটি গতানুগতিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের দিকে মনোযোগ না দিয়ে, বরং বনের প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষুন্ন রেখে কীভাবে টেকসই পর্যটন বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন করা যায় তার একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ করা হয়েছে।

মার্কিন জনগণের অর্থায়নে এবং ইউএসএআইডি (টঝঅওউ)-এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় বাংলাদেশ বন বিভাগ ও সোলিমার ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক তিন বছর মেয়াদী এই প্রজেক্টটি হাতে নেওয়া হয় ইউএসএআইডি ইকোট্যুরিজম অ্যাক্টিভিটি নামক একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে। এই পুরো প্রক্রিয়াটির ডেপুটি চিফ অব পার্টি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম।

প্রফেসর ওয়াসিউল ইসলাম জানান, ‘‘এই মহাপরিকল্পনা তৈরিতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে। এই মহাপরিকল্পনাটি মূলত সুন্দরবনের পরিবেশ ও অর্থনীতির সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল রোডম্যাপ। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশীয় পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি ঘটবে ও স্থানীয়দের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হবে এবং এর মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এই প্রকল্পটির উদ্দেশ্য মূলত: সুন্দরবন ও এর সংলগ্ন এলাকায় পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন (ইকোট্যুরিজম) উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও মার্কেটিং এর প্রসারের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে ত্বরান্বিত করা ও এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। বিদেশি পর্যটকদের কীভাবে আরও সুন্দরবনে আগ্রহী করে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনা যায়, এ বিষয়েও এ প্রকল্পটি কাজ করেছে। দেশের মানুষ ট্যুর করলে টাকা দেশেই থাকে, কিন্তু বিদেশি পর্যটক দেশে এলে নতুন বৈদেশিক মুদ্রা অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবনের কোলাহলমুক্ত, শান্ত, সুনিবিড় পরিবেশ এবং রাতের জ্যোৎস্না বিশেষভাবে উপভোগ করে থাকেন। এই চাহিদা কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয় করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।”

এই মহাপরিকল্পনার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজম মডেল অনুসরণ করা। বাংলাদেশ বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, ট্যুরিস্ট পুলিশ, স্থানীয় সরকার, মোংলা পোর্ট কর্তৃপক্ষ, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের ট্যুর অপারেটর, স্থানীয় লোকজনসহ বিভিন্ন অংশিজনের সঙ্গে পরামর্শ ও সমন্বয় করে এই মহাপরিকল্পনাটি প্রণয়ন করা হয়েছে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

ড. ওয়াসিউল আরও জানান, “মহাপরিকল্পনাটি স্থানীয় লোকজনের সাথে সমন্বয় করে প্রস্তুত করা হয়েছে, ফলে তাদের সাথে কোন সংঘাত হওয়ার সুযোগ কম। বরং সুন্দরবনের ভিতরে পরিবেশ-বান্ধব পর্যটনের সাথে কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজমেকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যেখানে স্থানীয়রা সরাসরি এটার সাথে জড়িত হয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে অনেক উপকারী হবে।”

মহাপরিকল্পনাটিতে বনের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই টেকসই মডেলে, স্থানীয়দের বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজমের মাধ্যমে বিকল্প ও অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত জীবিকা প্রদান করার পথ করা হয়েছে। এতে বনের বাস্তুতন্ত্রের উপর চাপ কমবে, যার ফলে ম্যানগ্রোভ বন আরও স্বাস্থ্যকর থাকবে এবং ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা জোরদার হবে। মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত, ট্যুরিস্টদের দেখভালসহ যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় এই প্রকল্পটি ২০০ জনেরও বেশি ইকো গাইডকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং প্রশিক্ষিত ইকো-গাইডদের সতর্ক তত্ত্বাবধানে পর্যটকরা বনের অভয়ারণ্যে প্রবেশ করতে পারবে যার ফলে পরিবেশগত সমস্যা কম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। স্থানীয়দের নিরাপদ অর্থনৈতিক বিকল্প দেওয়ায় এবং মানুষের অনুপ্রবেশ কমিয়ে দেওয়ায়, সংঘাতের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক বিচরণ ক্ষেত্র সুরক্ষিত থাকবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক জানান, “দাকোপ এলাকায় যে সকল ইকো-কটেজ স্থাপন করা হয়েছে এসব কটেজে কর্মরত স্থানীয় কর্মচারীদেরও গেস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং পর্যটক সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে পর্যটকদের সাথে কোনো ধরনের সংঘাত বা ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সুযোগ কম থাকে।”

এই মহাপরিকল্পনাটিতে পর্যটকদের সুবিধার জন্য কিছু অবকাঠামোগত পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মোংলা, মুন্সিগঞ্জ, শরণখোলা বা সুন্দরবনের প্রবেশমুখে তথ্য সেন্টার স্থাপন করা। এই সেন্টারগুলো থেকে পর্যটকরা সহজে বোট, নৌযান ভাড়া, ইকো গাইড নেওয়া এবং কমিউনিটি-বেজড ট্যুরিজমের সহায়তা পেতে পারে।

সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করার জন্য এই মহাপরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের, ডেপুটি চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্ট মো মঈনুদ্দিন খান বলেন, “সুন্দরবনে প্রায় প্রতি বছর ২ লক্ষ ট্যুরিস্ট আসে। তাই এখানে বনের ভারসাম্য ধরে রাখাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যেহেতু এই মাস্টারপ্ল্যানটি বনের ক্ষতি না করে আরও ভালোভাবে ইকো- ট্যুরিজম করা, সেহেতু আমি বলব এটা সত্যিই একটা ভালো পদক্ষেপ। সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। সেই সম্পদকে বাঁচিয়ে রেখেই যথাযথ উপায়ে এর ব্যবস্থাপনা করা অবশ্যই দরকার।”

স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানান, “ইতোমধ্যে কটেজগুলোতে কিছু অনিয়ম, ও অসামাজিক বিষয়াদির অভিযোগ আমরা প্রায় জানতে পারছি। তাই আমরা মনে করি সরকারিভাবে কটেজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে যদি মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সুন্দরবনের পরিবেশ বজায় থাকবে। পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় মানুষজনও বেশ উপকৃত হবে।”
এই ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা সুন্দরবনের ইকো-ট্যুরিজমকে কেবল একটি ভ্রমণ স্থান নয়, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ ও স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে আশাবাদী প্রজেক্টের সাথে সংশ্লিষ্টরা।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন