সংসারে অভাব অনটনের কারণে ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে যান খানজাহান আলী থানার শিরোমণি পূর্ব পাড়ার রাহিলা বেগম। সেখান থেকে ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের শিরোমণি শাখার রাখালীতে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ৭/৮ বছরের কষ্টার্জিত অর্থ জমা রাখেন সেখানে। লভ্যাংশ বেশি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে জমাকৃত অর্থ তুলে এফডিআর করার পরামর্শ দেন ব্যাংকের এজেন্ট ও রাখালি নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক শেখ মিরাজুল ইসলাম। তার প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে মেয়ের মাধ্যমে টাকা তুলে ৯ লাখ টাকার এফডিআর করেন প্রবাসী রাহিলা বেগম। পরে দেশে এসে জানতে পারেন মিরাজের প্রতারণা কথা। ব্যাংকের এজেন্ট মিরাজ আমানতকারীদের অর্থ মূল ব্যাংকের হিসাবে জমা না রেখে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করেন।
দেশে আসার আগেই রাহিলা বেগমের স্বামী মারা যান। বর্তমানে খুবই অর্থ কষ্টে রয়েছেন। সংসার চালাতে পারছেন না। এফডিআরের টাকারও কোনো হদিশ নেই। আদৌ সে টাকা পাবেন কিনা সেই দুশ্চিন্তায় তার খাওয়া ঘুম হারাম।
জানা যায়, রাহিলা বেগমের মতো ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের শিরোমণি শাখার রাখালি থেকে এলাকার শতাধিক আমানতকারীর প্রায় ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গত বছরের নভেম্বরে গা ঢাকা দেন মিরাজ। গ্রাহকের দায়ের করা মামলায় সে এখন কারাগারে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে তাঁর সহযোগীরা।
ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং এবং রাখালি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিরাজসহ ১২ জনের একটি প্রতারকচক্র এলাকার সহজ সরল নারী, পুরুষ মিলিয়ে শতাধিক গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ অধিক লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে এফডিআর করার কথা বলে টাকা ব্যাংকে ট্রানজিট না করে সে অর্থ আত্মসাৎ করে। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্রের হোতা মিরাজসহ তার সহযোগীরা।
আমানতকারীদের বিশ্বস্ততা অর্জনের লক্ষ্যে প্রথমাবস্থায় প্রতারকরা এফডিআরের লভ্যাংশের অর্থ ব্যাংকের কোডে জমা দিয়ে পরে সেই কোড নাম্বার আমানতকারীদের প্রদান করে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশের টাকা বন্ধ হয়ে যায়। তখন প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপরই মিরাজ গা ঢাকা দেয়।
অর্থ ফেরত পাবার আশায় প্রায় এক বছর ধরে ডাচ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মহলের কাছে ধরনা দিচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরা। আদালতে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা দায়ের হয়েছে মিরাজের বিরুদ্ধে। যার মধ্যে ১১ টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরা পাওনা টাকার দাবিতে ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন, গ্রাহক সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন অব্যাহত রেখেছে। ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীরা বলছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক দেখে তারা ব্যাংকের শিরোমণি এজেন্ট শাখায় জামানত করেছেন।
এক্ষেত্রে ব্যাংকের দায় আছে। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এজেন্ট ব্যাংকের ক্ষতিগ্রস্ত ওইসব আমানতকারীর দায় নিতে রাজি নয়। ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজার মোঃ সোহেল রানা বলেন, “যেহেতু তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করে নাই, এ কারণে তাদের দায়ভার ব্যাংকের নয়, এটা আনঅফিসিয়াল বক্তব্য। অফিসিয়াল বক্তব্য নিতে হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।”
রোজিনা সুলতানা নামে এক আমানতকারী বলেন, “২০২২ সালে তিন বছরের জন্য ১০ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করি। প্রথমে এরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। লেনদেনও ভালো করেছে। ব্যাংকের অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও বলেছেন ভালো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এরা যে এত বড় প্রতারণা করছে, এটা আমরা বুঝতে পারিনি। এরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে টাকা পয়সা নিয়ে ব্যাংকের এজেন্ট মিরাজকে সরিয়ে দিয়েছে। এদের সাথে এলাকার অনেক মানুষও জড়িত। আমরা সবাই গরিব, অসহায় মা-বোনেরা, কত কষ্ট করে টাকা জমায় এখানে রেখেছি।”
তিনি বলেন, “২০১৭ সাল থেকে ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের সাথে লেনদেন শুরু করি। প্রথমে তারা বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবহার করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের সমস্ত টাকা পয়সার অ্যাকাউন্ট এখানে ছিল। এ কারণে আমাদের বিশ্বস্ততা ও আস্থা বেড়ে যায়। প্রথম দিকে আমাদের সাথে ঠিকঠাক মতো লেনদেন করেছে। যখন তেতুলতলা রোড থেকে এখানে চলে আসে তখন থেকে মিরাজের আস্তে আস্তে পরিবর্তন দেখা যায়।”
মিয়া শাহিনুর রহমান বলেন, “৬/৭ বছর আগে ৪ লাখ টাকা রাখি। প্রথমদিকে আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছে। যখন সবার বিকাশ অ্যাকাউন্টে লভ্যাংশের টাকা ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমরা ব্যাংকের এজেন্ট মিরাজের প্রতারণার কথা জানতে পারি। এরপর আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটা জোট গঠন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকি। এরপর থেকে মিরাজ উধাও। তাকে আর পাওয়া যায় না। ফোন করলে বলে ঢাকায় আছি। এক পর্যায়ে ফোনেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন আমরা ব্যাংকে যোগাযোগ করি, ব্যাংক থেকে কিছু বলতে পারে না। এরপর মিরাজের বিরুদ্ধে আমরা মামলা, প্রতিবাদ সভা, সাংবাদিক সম্মেলন শুরু করি।”
লাবনী বেগম বলেন, “অ্যাকাউন্ট খুলে ৩৫ হাজার টাকা জমা রাখি। জমা সিলিপ চাইলে বলে সার্ভারে সমস্যা পরে এসে নিয়ে যেয়েন। কিন্তু পরে আসলেও জমা রশিদ দেয় না।”
মর্জিনা বেগম বলেন, “তিন বছর হলো দেড় লাখ টাকা রাখিসি। এখনও টাকা-পয়সার কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছি না। আমার মেয়ে অসুস্থ। টাকার অভাবে চোখ অপারেশন করতে পারতিছি না। নিজেও অসুস্থ, স্বামী মৃত্যু শয্যায়। টাকা পয়সার কোনো ম্যানেজ করতি পারতিছি না।”
খুর্শিলা খাতুন বলেন, “২০২২ সালের নিজের নামে দুই লাখ টাকা এবং স্বামীর নামের ৪ লাখ টাকা রাখি। মিরাজের কাছে প্রশ্ন করি আপনি মিরাজ যদি মারা যান তাহলে এই টাকা কার কাছ থেকে নিব? তখন সে আমাদের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটা কাগজ দেয়। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের কাগজপত্র দেখে আমরা আশ্বস্ত হই। এরপর আমরা লেনদেন করি।”
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের টাকা উদ্ধারের জন্য একটি আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়েছে। উক্ত কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে আহ্বায়ক শেখ আসলাম হোসেন বলেন, “২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের এজেন্ট মিরাজসহ ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এজেন্ট ব্যাংকের শতাধিক গ্রাহকদের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়। প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং পুরুষরা আইনি সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য বিজ্ঞ আদালতে একাধিক মামলা করে। বর্তমানে ১৫ টি মামলা চলমান। এর মধ্যে ১১ টি মামলায় মিরাজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিল এর মধ্যে কিছু ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে এসেছে। প্রতারক চক্রের মাস্টারমাইন্ড জেল হাজতে রয়েছেন। অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের জীবনের শেষ সম্বল টুকু হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব।” তিনি বলেন, “আগামী তিন মাসের মধ্যে গ্রাহকদের ৪ কোটি টাকা ফেরত না দিলে শিরোমণি এজেন্ট ব্যাংকের সামনে গ্রাহকরা আত্মাহুতি দিবে।”
সদস্য সচিব জিয়াউল হক জিয়া বলেন, “ডাচ-বাংলা একটি সুপরিচিত অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। দেশে বিদেশে যাদের সুনাম রয়েছে। কিন্তু কিছু কালোবাজারি, দুষ্কৃতিকারী, অর্থলোভী, মুনাফাখোর প্রান্তিক পর্যায়ের শতাধিক গ্রাহকের ব্যাংক ফর্মালিটিজ করে ৪ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা ডকুমেন্টস করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন খুলনা, পিবিআই, পুলিশ কমিশনারসহ খানজাহান আলি থানায় অভিযোগ দিয়েছি।”
এদিকে সরজমিনে শিরোমণি হাজি মার্কেটের দোতলায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শিরোমণি শাখার রাখালীতে গিয়ে দেখা যায় ব্যাংকের গেটের সামনে প্যানায় লেখা বিশেষ বিজ্ঞপ্তি।
বিজ্ঞপ্তির নিচে লেখা ‘এতদ্বারা সকল ডান্স বাংলা ব্যাংকের গ্রাহক কে জানানো যাচ্ছে যে, ডাচ-বাংলা ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শিরোমণি শাখা (রাখালি) আউটলেটের লেনদেন সাময়িক বন্ধ আছে। আপনার প্রয়োজনীয় লেনদেনের জন্য পার্শ্ববর্তী আউটলেট (ফুলবাড়িগেট ও আফিল গেট শাখায়) যোগাযোগ করুন। সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আদেশক্রমে সিনিয়র রিজিওনাল ম্যানেজার ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং খুলনা রিজিয়ন, খুলনা। যোগাযোগ: মোঃ সোহেল রানা। মোবাইল নং: ০১৩২১১৮১৬১৯।
খুলনা গেজেট/এনএম