টিকে থাকার লড়াইয়ে খুলনার মৃৎশিল্প

একরামুল হোসেন লিপু

“আগে মাটি বিনা পয়সায় আনতাম, এখন এক পিকআপ মাটির দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা, এক কৌটা রঙের দাম ৬০ টাকা টাকা থেকে এখন ১৪০ টাকা, কাঠের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক, কিন্তু সেই অনুপাতে মালের দাম বাড়েনি, বাজারে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র বের হওয়ায় আমাদের মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেছে, বংশ পরস্পরায় এই কাজ করে আসছি, পূর্বপুরুষের পেশা, ছাড়তেও পারছিনা। টিকে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এক সময় অনেক পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। টিকে থাকতে না পেরে আস্তে আস্তে বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অনেক পরিবার ভারতেও চলে গেছে। আমাদের সেনহাটী দক্ষিণ পালপাড়ায় ১৫টি পরিবার এবং উত্তর পালপাড়ায় ২৫ টি’র মত পরিবার বাপ দাদার এ পেশাকে কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছি। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করতো, তাহলে একটু বাঁচতাম”। এভাবেই খুলনা গেজেট’র এই প্রতিবেদককে পূর্বপুরুষের পেশায় টিকে থাকার গল্প বলছিলেন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী দক্ষিণ পালপাড়ার ৭০ বছর বয়সী সমীর চন্দ্র পাল।

স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন ছোট্ট একটি টিনের একচালা ঘরে। ছোট মেয়ে মিতা পড়াশোনা করেন খুলনার সরকারি বিএল কলেজে। পরিবারের সবাই মাটির কাজ করে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। সমীর চন্দ্র পালের মতো সবাই কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে টিকে আছেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন মাটির শিল্পের এ পেশায়।

এক সময় কুমারপাড়ার মেয়েরা কাজের ব্যস্ততায় দম ফেলার সময় পেতো না। কাঁচামাটির গন্ধ ভেসে আসতো চারদিক থেকে। হাট-বাজারে মাটির তৈজসপত্রের পসরার চাহিদা ছিল অনেক। বর্তমানে মৃৎশিল্প কালের বিবর্তনে কমে যাচ্ছে।

কঠিন এই লড়াইয়ে সমীর চন্দ্র পাল টিকে থাকার চেষ্টা করলেও নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে টিকতে না পেরে অনেকেই এ পেশা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। বেছে নিচ্ছেন ভিন্ন পেশা।

খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গোয়ালপাড়া গ্রামের পালপাড়ায় যে কয়টি পরিবার নিভু নিভু করে পৈত্রিক এ পেশাকে টিকিয়ে রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অরুণ পাল।

তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, “আমাদের মৃৎ শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। বাপ দাদার এ পেশা শিখেছি বাবার কাছ থেকে, ছাড়তে পারছি না, মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, কাঠ এবং রঙের অনেক দাম। কাট মিলাতেও পারিনা, তারপরও, কি করব? লেখাপড়া করতে পারিনি, এটাই শিখেছি। কিন্তু এটা করতেছি খুব কষ্টে। এটা করে আমাদের সংসার ঠিকমতো চলছে না। সরকার থেকে কোন সহযোগিতা বা আমাদের কোন খোঁজ খবরই নেয় না। যদিও সময় সময় কেউ আসে যা কিছু তথ্য নেওয়ার নিয়ে চলে যায়, আর কোন খোঁজ খবর নেয় না। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে চার সদস্যের পরিবার। ছেলেটা এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে। মেয়েটা ক্লাস এইটে পড়ছে। মাটির এই কাজ করে সংসার চালানো, ছেলে-মেয়ে দু’টোকে লেখাপড়া করানো আমার পক্ষে যে কি কষ্টের বলে বুঝানো যাবে না। সরকার যদি আমাদের একটু আর্থিক সহায়তা দিত। তাহলে ছেলে-মেয়ে দু’টোকে লেখাপড়া শিখাতে পারবো। এই ভূতের খাটনি থেকে ছেলে-মেয়েকে একটু অব্যাহতি দিতে পারব’।

একই পাড়ার নিতাই চন্দ্র পাল বলেন, “বাপ-দাদার পূর্বপুরুষ থেকে আমরা মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। এখন ব্যবসা সীমিত আকারে হয়ে গেছে। আগে প্রচুর মাল তৈরি করেছি। চাহিদাও ছিল। এখন তেমন কাজও নেই। মাসে বেঁচে কিনে ১৪-১৫ হাজার টাকা থাকে। এত সীমিত আকারে ইনকাম প্রতিবেশী যারা আছে, এই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পথে। অনেকে ইতিমধ্যে ছেড়েও চলে গেছে। আমাদের এখানে ২/৩ টা ঘর এই পেশায় টিকে আছি। এখন জিনিসের যে দাম হয়েছে, তা জোগাড় করে এ পেশায় টিকে থাকা যাচ্ছে না। লোন উঠিয়ে ব্যবসা করছি।”

দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম বলেন, “সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বলতে এখন যারা মৃৎশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন তাদেরকে আমরা ঋণ প্রদান করে থাকি বিআরডিবি, যুব উন্নয়ন থেকে। আলাদা করে এ পেশার জন্য সরকারি কোনো প্রণোদনা নেই। তবে ভবিষ্যতে যদি সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, তখন দেওয়া যাবে।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন