বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন মারাত্মক হুমকির মুখে। পূর্ব সুন্দরবনের নদী-খাল-বিলে নির্বিচারে ছড়ানো হচ্ছে ‘রিপকার্ড, রোটেনন, কার্বোফুরান’-এর মতো প্রাণঘাতী কীটনাশক। এসব বিষ ব্যবহার করে মাছ ধরছে অসাধু জেলেরা। ফলে ধ্বংস হচ্ছে বনজ জীববৈচিত্র ও ইকোসিস্টেম, আর বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে বিষাক্ত মাছ। এতে সরাসরি ঝুঁকির মুখে পড়ছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনলাইন ও স্থানীয় দোকান থেকে সহজেই এসব কীটনাশক কেনা যাচ্ছে। প্রয়োজন নেই কৃষি কার্ড বা জাতীয় পরিচয়পত্র। চোরা পথে ভারত থেকেও আসছে বিপুল পরিমাণ বিষ। পরিচয় গোপন রেখেই জেলেরা কিনছে বিষ এবং নির্বিঘ্নে ঢুকছে সুন্দরবনের নদী-খালে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পাশ নিয়ে মাছ ধরার নামে অনেকে জাল বা বড়শি নয়, সরাসরি বিষ ঢালছে পানিতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেসে উঠছে হাজার হাজার মাছ। কিন্তু এতে শুধু মাছ নয়, কুমির, ডলফিন, শামুক-ঝিনুক, জলচর পাখিসহ গোটা ইকোসিস্টেম ধ্বংস হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে বিষাক্ত পানি ও মাটির কারণে বিপন্ন হচ্ছে বনাঞ্চলের অন্যান্য প্রাণীও।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় মাছের ডিপো মালিক ও দাদনদাররাই এই বিষ শিকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। বেশি লাভের আশায় তারা সরাসরি জেলেদের হাতে বিষ তুলে দিচ্ছে। বিষাক্ত মাছ ডিপো হয়ে বাজারে চলে যাচ্ছে। ভোক্তারা অজান্তেই কিনে খাচ্ছেন এসব মাছ।
বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, “এসব মাছ খেলে মানুষের লিভার, কিডনি, ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অভিযোগ থাকলেও বনবিভাগ জানিয়েছে, তারা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। গত তিন মাসে ১৭৯টি অভিযানে ১৪৮ জন গ্রেপ্তার, ৪২ মণ বিষাক্ত মাছ, ২২ বস্তা শুটকি, ৩৭৫ কেজি কাঁকড়া, ১৩ হাজার ৭০০ ফুটের বেশি জাল, ২৪২টি ট্রলার ও নৌকা এবং ৫৮ বোতল বিষ জব্দ করা হয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ড্রোন ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। বনরক্ষীরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে এবং দায়িত্বে অবহেলা পেলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ মোতাহার হোসেন বলেন, “যে কীটনাশক ফসলে প্রয়োগ করলে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হয়, সেই একই বিষ দিয়ে ধরা মাছ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজারে চলে যাচ্ছে। এতে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। লাইসেন্সধারী বিক্রেতাদের মনিটরিং চলছে, তবে অননুমোদিত বিষের চোরাচালান ঠেকাতে প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও বনবিভাগের যৌথ উদ্যোগ জরুরি।”
পরিবেশবাদী ও স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন বিষের অবাধ বিক্রি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, ডিপো মালিক ও দাদনদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং জেলেদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা। না হলে সুন্দরবনের মৃত্যুফাঁদ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
খুলনা গেজেট/এনএম