বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হবে আজ, কী থাকছে সনদে

গেজেট ডেস্ক

দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে প্রায় আট মাস ধরে তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শেষে তৈরি করা ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে শুক্রবার। এদিন বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ সই হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সদস্যরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দুজন করে প্রতিনিধি এই সনদে সই করবেন।

গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের (সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন) সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়।

গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে ওই খসড়ায় কিছু ত্রুটি থাকায়, তা সংশোধন করে নির্ভুল খসড়া পাঠানো হয়। এরপর গত ২০ আগস্ট ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে খসড়াটির ওপর যেকোনো ধরনের মতামত দেওয়ার সময় ২২ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর আবারও জুলাই সনদের নানা বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কমিশনের আলোচনা হয়।

কোন কোন প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে?

কয়েক মাসের ধারাবাহিক সংলাপের পর গত ১৬ই অগাস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠিয়ে এ নিয়ে মতামত নেয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

পরে গত ১১ই সেপ্টেম্বর এটির চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হয় দলগুলোর কাছে। এরপর সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আরো দুই দফা দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ঐকমত্য কমিশন।

মঙ্গলবার রাতে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের যে চূড়ান্ত কপি পাঠিয়েছে, তাতে দেখা গেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে বেশিরভাগ দলই একমত হয়েছে।

যেমন- একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার বিষয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই একমত হয়েছে।

ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল করার বিষয়ে একমত বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল এবং জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে একমত বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।

জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পক্ষে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি দল।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট ঐকমত্য পোষণ করেছে। তবে এতে ৯টি রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৯টি রাজনৈতিক দলই একমত। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার বিধানের বিষয়েও অধিকাংশ দল একমত।

জাতীয় সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব পর্যায়ক্রমে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ সব দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে একমত ৩০টি দল; স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি গঠনেও দলগুলোতে মতৈক্য হয়েছে; গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কমিশন গঠনের প্রস্তাবেও ঐকমত্যে পৌঁছেছে ৩২টি দল।

ভিন্নমত আছে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে?

এক ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না। এ প্রস্তাবে ২৫টি দল একমত হয়েছে। বিএনপিসহ পাঁচটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।

সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিত করণের বিষয়ে ২৯টি রাজনৈতিক দল একমত হলেও ভিন্নমত জানিয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল।

সংসদের সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনে মতপার্থক্য রয়েই গেছে শেষ পর্যন্ত। উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে জামায়াত এনসিপিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট। এতে ভিন্নমত বিএনপিসহ সাতটি রাজনৈতিক দল ও জোটের।

সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখ থাকবে। যেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা কথাটি থাকবে না। তবে প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৭টি দল একমত হলেও গণফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডিসহ কয়েকটি দল ভিন্নমত পোষণ করেছে।

সংবিধানের বর্তমান অনুচ্ছেদের সংশোধনপূর্বক ৭৭(১) এ যুক্ত করা হবে যে, এই সংবিধানের অধীনে একজন ন্যায়পাল থাকবেন। এতে ২৫টি দল একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেছে পাঁচটি দল।

জুলাই সনদে স্বাক্ষর পরবর্তী নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়নের বিষয়ে ২৭টি দল একমত হলেও ভিন্নমত দিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।।

‘নোট অব ডিসেন্ট’ যেগুলোতে, সেগুলোর কী হবে?

গত অগাস্টে যখন জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেওয়া হয়েছিল, তখন সেখানে কোন কোন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে কিংবা কোন কোন প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়নি সেটা উল্লেখ করা হয়েছিল।

গত মঙ্গলবার রাতে দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি পাঠানো হয়। সেখানে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের সবগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

একই সাথে সেই প্রস্তাবনার পাশে কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত জানিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ যে বিষয়গুলো আছে সেখানে যেহেতু কিছু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, সেটাকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে”।

যে কারণে চূড়ান্ত সনদে এই বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সংস্কারের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্টকে (ভিন্নমত) স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

জুলাই সনদে দেখা গেছে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি সংস্কারের সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, “যে সব দল সনদের যে সব প্রস্তাবনায় নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, ওই দলগুলো নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে ওই সংস্কার প্রস্তাব মানতে বাধ্য থাকবে না”।

সনদ সাক্ষরের পর বাস্তবায়ন কীভাবে?

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা থাকবেন। প্রতিটি দল থেকে জুলাই সনদে সই করবেন দুইজন প্রতিনিধি।

এরই মধ্যে জুলাই সনদে সই করতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দুজন করে প্রতিনিধির নাম ঐকমত্য কমিশনে পাঠিয়েছে।

শুক্রবার সব রাজনৈতিক দল এই জুলাই সনদে সাক্ষর করার কথা। এটি সাক্ষরের পর। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সরকারকে সুপারিশ করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

গণভোট কবে ও কীভাবে হবে?

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে পেতে গত ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নেওয়ার জন্য একটি গণভোট আয়োজনের কথাও জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

গত পাঁচই অক্টোবর কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাদের সম্মতির জন্য গণভোটের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, গণভোটের বিষয়ে সব দল একমত হলেও কবে, কিভাবে এবং কোন কোন বিষয় তাতে থাকবে সেটি এখনই চূড়ান্ত নয়। তবে ঐকমত্য কমিশন সংশ্লিষ্ট একজন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন- এই গণভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এবং সেটি সরকারের পরামর্শেই তারা করবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেদিন অনুষ্ঠিত হবে, সেই একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হচ্ছে। তবে সরকার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না জানানোয় এ নিয়ে এখনই কোনো মতামত দেয়নি কমিশন।

তবে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করা হলে খরচ কিছুটা কম হলেও জনবল ও ভোট কক্ষের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

গণভোট ইস্যুতে সরকার বা নির্বাচন কমিশন এখনো কোনো সিদ্ধান্ত না জানালেও এরই মধ্যে গণভোট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতপার্থক্য ও বিরোধ দেখা যাচ্ছে।

গণভোট ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করা। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই গণভোটের পক্ষে।

যদিও এই গণভোট ইস্যুটি এখনো পুরোটাই ধোঁয়াশার মধ্যেই থাকছে যতক্ষণ না অন্তর্বর্তী সরকার এটি নিয়ে তাদের চূড়ান্ত মতামত জানাচ্ছে।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন