আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশ দেশের আলেম ওলামাদের বীরোচিত লড়াই ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রেরণা জুগিয়েছিল। সেদিন শাপলায় হেফাজতে ইসলাম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আমরা হয়তো জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেখতাম না। এই জুলাই অভ্যুত্থানের মূল মাস্টারমাইন্ড ছিলেন আল্লাহতায়ালা। কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মানুষের মধ্যে এই মাস্টারমাইন্ড খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই মিসটেক করেছেন। এই ভুলের কারণেই ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদ্রাসায় আয়োজিত “বায়তুশ শরফ গুণীজন সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে তিনিসহ চার গুণীজন বায়তুশ শরফ গুণীজন সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (ম:জি:আ.) মাহমুদুর রহমানকে স্বর্ণপদক পরিয়ে দেন৷
ড. মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, আমাদের লড়াই আত্মপরিচয়ের। ১৯৪৭ সাল থেকে আমাদের আত্মপরিচয় নিয়ে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পরিকল্পিতভাবে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রেখেছে। আর এই জন্যই আমাদের শেখানো হয়েছে আমরা বাঙালি। যখন এটি শেখানো হয় সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের মুসলমানিত্ব ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারি। এবং হয়েছেও তাই। আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারিনি।
আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে কৌশলে আমাদের মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে ভারত আমাদের তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এটা প্রচার করা হয় না যে আমরাও ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত ৭টি রাজ্যকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছি। এই ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ একটি জিও পলিটিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী রাষ্ট্র হতে পারে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে জানিয়ে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, ১৬ বছর ধরে জাতির পিতার দীক্ষা দেয়া হয়েছে, হিন্দুত্ববাদের দীক্ষা দেয়া হয়েছে। তরুণদের মোরালিটি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, আবার আমি দেখছি আমাদের তরুণদের মধ্যে মুসলমানিত্ব ফিরে আসছে। বাংলাদেশে ইসলামের নবচেতনা দেখতে পাচ্ছি। যদিও অনেক রাজনীতিবিদ সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন না। এই বাঙালিয়ানা ভুলে যেতে হবে। আমাদের বলতে হবে আমরা বাঙালি মুসলমান।
তিনি আরও বলেন, ১৯ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদ বাঙালি মুসলমানকে ইসলামি রেনেসাঁর বাইরে রেখেছিল। আর সেটা তৈরি করেছিল হিন্দুরা। ব্রিটিশরা তাতে সহযোগিতা করেছিল। অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন, প্রথম ১০০ বছর মুসলমানরা অব্যাহত লড়াই করে গেছে। ব্রিটিশরা চেয়েছিল আমাদের সাথে লড়াই করতে। এজন্য আমাদের মুসলমানিত্ব ভুলিয়ে দিয়ে বাঙালিত্ব ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাদের পাঠ্যবইয়ে তিতুমীর, শরীয়ত উল্লাহকে নিয়ে কোনো গল্প নেই, সেগুলো শেখানো হয় না। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি প্রার্থীরা সবাই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আমাদের অজান্তেই বাংলাদেশে এই পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি জানান, ইতিহাস না জানলে সাংস্কৃতিক লড়াই করা যাবে না। বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁর থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। বাঙালি মুসলমানের রেনেসাঁয় ফিরতে হবে আমাদের। কোরআনে আল্লাহ জ্ঞান চর্চা করতে বলেছেন। আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে গেছি। দ্বিতীয় হলো আমাদের মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি, অনৈক্য চরম আকার ধারণ করেছে। এই দুটো ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমাদের ঐক্য, হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে আছি বলেই আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে পারছি না। আমরা আজ তাদের হাতে মার খাচ্ছি।
গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এ পদকের জন্য মনোনীত করে বায়তুশ শরফ আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ। এ বছর আরো তিন গুণীজন এই পদকে ভূষিত হয়েছেন। তারা হলেন, জাতীয় পর্যায়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রচার-প্রসার এবং সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক কবি আবদুল হাই সিকদার, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চায় বিশেষ অবদানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মুহিবউল্ল্যাহ ছিদ্দিকী, ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী দর্শন ও ইসলামী সংস্কৃতি বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল।
রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়খ আবদুল হাই নদভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বায়তুশ শরফ কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু সালেহ মোহাম্মদ ছলীমুল্লাহ, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
রাহবারে বায়তুশ শরফ ও আনজুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ-এর সভাপতি আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (মা.জি.আ.) গুণীজনদের পদক পরিয়ে সম্মাননাপত্র তুলে দেন। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বায়তুশ শরফ প্রাঙ্গণে কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর বায়তুশ শরফ শিল্পীগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সংবর্ধিত অতিথিদের সম্মাননাপত্র পাঠ করেন।
১৯৮২ সালে বায়তুশ শরফ মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সারা দেশে সাতশত প্রতিষ্ঠান রয়েছে বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের। কেবল চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদ্রাসায় ছয় হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। জেনারেল শিক্ষার পাশাপাশি কোরআন, হাদিস, হিফজ, নাজারাহ বিভাগসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে পাঠদান হয়ে থাকে মাদ্রাসায়। এখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, তামাদ্দুনিক মানবসেবার প্রত্যেকটি কর্মসূচি রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বায়তুশ শরফ মাদ্রাসা যুগ যুগ ধরে দ্বীন ইসলামের প্রচার-প্রসারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। মাদ্রাসাটি জাতীয় পর্যায়ে তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ১৯৯৪ সাল থেকে গুণীজনের কদর করতে এবং সমাজে তাদের অবদান জানাতে বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ:) এই সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক প্রচলন করেন। এ বছরও আজিমুশশান মিলাদ মাহফিল, পাখপাখালির আসর, শানে মোস্তফা (সা:)-সহ পাঁচ দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়।
গত বছর এই পদকে ভূষিত হয়েছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী, প্রখ্যাত ইসলামী সাহিত্যিক প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান, লেখক ও গবেষক মো. মুখলেসুর রহমান, কবি আল্লামা মুহিব খান।
খুলনা গেজেট/এনএম