করোনার বিস্তার রোধে আজ বৃহস্পতিবার থেকে খুলনাসহ সারাদেশে সাত দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। সর্বাত্মক লকডাউন নিশ্চিত করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে মাঠে নামছেন সেনা ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।
বুধবার (৩০ জুন) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনার বিস্তার রোধে আরোপিত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের জন্য ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’- এর আওতায় ১ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা স্থানীয়ভাবে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করবেন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। বিধিনিষেধ কার্যকরে বিজিবির পাশাপাশি উপকূলে মোতায়েন থাকবে কোস্টগার্ড।
এরআগে বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি করে বলা হয়েছে, জরুরি কারণ ছাড়া আজ থেকে ঘরের বাইরে বের হলেই গ্রেপ্তার করা হবে। বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে এবার দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। এ ধারার মামলায় সর্বোচ্চ ছয় মাসের সাজা, জরিমানা বা উভয় দণ্ডই হতে পারে। এ ছাড়া লকডাউনে সীমিত পরিসরে সোমবার থেকে পরবর্তী চার দিন ব্যাংক খোলা থাকবে। লেনদেন হবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। এ ছাড়া লকডাউনের মধ্যে খোলা থাকবে তৈরি পোশাক কারখানা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, সংবাদপত্রসহ জরুরি পরিষেবা চালু থাকবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রথমে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও তা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে, বুধবার বিকেলে ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার ও বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটপ্রধানের সঙ্গে একযোগে ভার্চুয়াল বৈঠক করে লকডাউন বাস্তবায়নের করণীয় নিয়ে দিকনির্দেশনা দেন পুলিশ মহপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে বিধিবিধান প্রতিপালনের পাশাপাশি কেউ যাতে অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সেদিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিজিবি পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সিভিল প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী সারাদেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ফোর্স মোতায়েন করতে প্রস্তুত বিজিবি।
মাঠে থাকবেন ১০৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট : সারাদেশের আটটি বিভাগে ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮-এর ১০(৫) ধারা অনুযায়ী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারা অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের আওতাধীন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কর্মকর্তাদের।
ডিএমপি কমিশনারের হুঁশিয়ারি : লকডাউনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কেউ বের হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হবে।
আদালত বন্ধ ৭ জুলাই পর্যন্ত : কঠোর লকডাউনের মধ্যে দেশের সব আদালত ৭ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ থাকছে। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আদালতের ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রত্যেক মুখ্য বিচারিক হাকিম বা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একজন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী জেলা বা মহানগরে মুখ্য বিচারিক হাকিম বা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এক বা একাধিক হাকিম স্ব্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শারীরিক উপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে সর্বোচ্চ আদালতের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কাজও সীমিত পরিসরে চলবে। এ ছাড়া অধস্তন আদালতে বিচারক এবং আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থল না ছাড়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ ও চেম্বার আদালতের বিচারকাজও সীমিত পরিসরে ভার্চুয়ালি চলবে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৬ ও ৭ জুলাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিলের শুনানি হবে। এতে আরও বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগে তিনটি ভার্চুয়াল বেঞ্চ চলবে। রিট ও দেওয়ানি, ফৌজদারি এবং কোম্পানি ও অ্যাডমিরালটি সংক্রান্ত একটি করে মোট তিনটি বেঞ্চ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে অতীব জরুরি বিষয়ে শুনানি করবেন। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বিচারপতি ও আইনজীবীদের না আসার অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে লকডাউনে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে নামাজ আদায় করতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, সাবান-পানি রাখার কথা বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
যা বন্ধ থাকবে : মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গতকালের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। এসব বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীও মাঠে থাকবে। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহনসহ সব ধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন এবং অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে। শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট এবং পর্যটনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ থাকবে। জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করা যাবে না। অতি জরুরি প্রয়োজন (ওষুধ-নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার) ছাড়া কেউ কোনোভাবে ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না। নির্দেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যা খোলা থাকবে : আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিষেবা (কৃষিপণ্য-উপকরণ-খাদ্যশস্য-খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্ব্বাস্থ্যসেবা, করোনা টিকাদান, রাজস্ব আদায় কার্যাবলি, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস-জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন, ইন্টারনেট, গণমাধ্যম, বেসরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থা, ডাকসেবা, ব্যাংক, ফার্মেসি, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ জরুরি পণ্য-সেবার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে পারবে)। পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যান, কার্গো ভেসেল নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। বন্দরগুলো (বিমান, সমুদ্র, নৌ, স্থল) ও সংশ্নিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে। শিল্পকারখানা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। কাঁচাবাজার-নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি (অনলাইনে কেনা বা খাবার নিয়ে যাওয়া) করতে পারবে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু থাকবে। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকিট প্রদর্শন করে গাড়িতে যাতায়াত করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ধর্ম মন্ত্রণালয় তাদের সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করেছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত সোমবার থেকেই সারাদেশে গণপরিবহন, শপিংমল, মার্কেটসহ বেশ কিছু কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এমএম