খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতা গাজী জাকির হোসেন এবং বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী শেখ আনছার আলীর বিরোধের কারণে ক্রমাম্বয়ে অশান্ত হয়ে উঠছে এলাকা। দু’পক্ষের বিরোধের কারণে প্রতিপক্ষের হামলা, ভাংচুর, সংঘর্ষ, লুটপাট এবং মামলার ভয়ে দু’গ্রুপের অনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকা ছাড়া।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজী জাকির হোসেন এবং শেখ আনছার আলীর মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে গত বছর ১৭ মার্চ ১ম ধাপের করোনাকালীন সময়ে। ওইদিন বারাকপুর বাজারে শেখ আনছার আলীর গ্রুপের সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হন গাজী জাকির হোসেন। একইদিন হামলা করা হয় গাজী জাকির হোসেনের বাড়িতে। আক্রমণের শিকার হন গাজী জাকির হোসেনের বড় ভাই বারাকপুর বাজার কমিটির সভাপতি গাজী নাসির উদ্দিন। পিটিয়ে তার হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়। এছাড়া বারাকপুর বাজারে হামলার শিকার হন গাজী জাকির হোসেনের সমার্থক ইখলাস শেখ, তৌহিদুল বিশ্বাস, শেখ মাহাবুব ও রিগ্যান। এক কথায় ওইদিন গাজী জাকির হোসেনকে লাঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে বারাকপুর বাজারে তান্ডব চালিয়ে গাজী জাকির হোসেনের বাড়ি, সমর্থক এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে শেখ আনছার আলী গ্রুপ নিজেদের শক্তি জানান দেয়। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়। মামলা নং-জি আর ২৯/২০।
এ ঘটনার দুই দিন পর ১৯ মার্চ ২০২০ আবারও বারাকপুর বাজারে হামলার শিকার হন গাজী জাকির হোসেন। একই সঙ্গে হামলার শিকার হন তার সমর্থক শহিদুল চৌধুরী, শেখ খাজা, মাসুম মোল্যা, আমানত শেখ ও আলম শেখ। এ ঘটনায় মামলা নং-জি আর ২১/২০।
একইদিন সন্ধ্যায় হামলার শিকার হন গাজী জাকির হোসেন এর সমর্থক লাভলু শেখ, মাসুদ শেখ ও নাসির ঢালী। দোকানপাট, বাড়ি, সাইকেল ভাঙচুর ও মৎস্য ঘের লুটপাট করা হয়। এ ঘটনায় জি আর মামলা নাম্বার ৩২/২০।
একই বছরের ১৭ মে নন্দনপ্রতাপ ও আড়ুয়া গ্রামে মনিলাল রায় ও গোপাল বিশ্বাসের দোকানে লুটপাট হয়। ২৪ মে বারাকপুর বাজারে গাজী জাকির হোসেনের চাচাতো ভাই গাজী মোস্তাকের ওপর হামলা চালিয়ে পিটিয়ে তার হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মৃত ভেবে তাকে ফেলে রেখে যায়। পরে এলাকাবাসী উদ্বার করে তার অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের লোকজন তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও তিনি এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। এ ঘটনায় জি আর মামলা নাম্বার ৩৫/২০।
এরপর ৫ জুলাই তহিদুল বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা এবং লুটপাট করা হয়। এ ঘটনায় দিঘলিয়া থানায় জিডি নাম্বার ১৮৫। ৭ আগস্ট বিল্লাল চৌধুরীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় জি আর মামলা নাম্বার ৪১/২০।
৯ নভেম্বর আশীষ ভদ্র নামে বারাকপুর বাজারের এক দোকানদারকে উচ্ছেদের হুমকি ও তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। ১৩ নভেম্বর নন্দনপ্রতাপ গ্রামের বেল্লাল চৌধুরীর বাড়িতে হামলা ও তার স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়।
এ বছরের ৩ জানুয়ারি বিল্লাল চৌধুরী হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় মামলা নাম্বার এম সি ৭/২১। ২৬ মার্চ নন্দন প্রতাপ ব্রিজের উপর হামলার শিকার হন পাভেল গাজী, আজাদ মোড়ল, শহিদুল মোড়ল ও সোহেল শেখ। এ সময় তাদের ব্যবহৃত চারটি মোটরসাইকেল প্রতিপক্ষ ভাংচুর করে ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনার জের ধরে বারাকপুর বাজার এবং লাখোহাটী বাজারে দু’গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের ৯ জন আহত হয়। হামলা এবং ভাংচুর করা হয় শেখ আনছার আলীর বাড়িতে। এ ঘটনায় সিআর মামলা নম্বর ৪৪/২১ এবং দিঘলিয়া থানায় মামলা নং ৯ তাং ২৮/০৩/২০২১। এ ঘটনার জের ধরে একইদিন রাতে মুজিবর শেখ, আলম শেখ ও সোহেল শেখের দোকান ও বাড়িতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় জি আর মামলা নাম্বার ২৯/২১।
গত ২৯ মার্চ প্রতিপক্ষের উপর হামলা, ভাংচুর এবং লুটপাটের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় শেখ আনছার আলীকে। পরবর্তীতে তিনি জামিনে বের হয়ে এসে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন।
৭ মে বিকালে নন্দনপ্রতাপ ব্রিজের উপর শেখ আনছার আলীর চাচাতো ভাই মৎস্য ব্যবসায়ী রেজাউল শেখ (৫২) কে প্রতিপক্ষের ৪/৫ জন যুবক হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। এ সময় তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি লাখোয়াটি থেকে ইফতারি নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে দিঘলিয়া থানায় মামলা নাম্বার ২ তাং ০৯/০৫/২০২১
এরপর ১৪ মে ঈদের দিন রাতে লাখোয়াটী গ্রামের সাগর মোল্যার মৎস্য ঘেরে বিষ প্রয়োগের ফলে আনুমানিক ৮০ মণ মাছ মরে যায়। যার আনুমানিক মূল্য ৭ লক্ষাধিক টাকা।
১৮ মে সকালে রাধামাধবপুর গ্রামে প্রতিপক্ষ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে উজ্জ্বল মোল্যা (২২) নামে এক যুবককে। এ ঘটনায় ১টি মামলা দায়ের হয়।
৩ জুন মল্লিকপুর গ্রামে প্রতিপক্ষের হাতে হামলার শিকার হন গাজী জাকির হোসেনের সমর্থক আজিজুর চৌধুরী। এসময় তাকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এ ব্যাপারে দিঘলিয়া থানায় মামলা হয়। এ ঘটনার জের ধরে গত ৪ জুন সকালে প্রতিপক্ষের উপর হামলা করতে এসে নন্দনপ্রতাপ ব্রিজের উপর পুলিশের চ্যালেঞ্জের মুখে ৫ টি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায় ৫ যুবক। পুলিশ এ সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে ১টি পিস্তল, দুই রাউন্ড, গুলি, ১টি ককটেল, ৫ টি মোটরসাইকেল ও ১ টি বড় ছোরা উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় দিঘলিয়া থানায় মামলা নম্বর-৩ তাং ০৪/০৬/২০২১।
এদিকে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়েছেন শেখ আনছার আলীর একাধিক সমর্থক। ভাংচুর করা হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শেখ আনছার আলীর বাড়িতেও হামলা এবং ভাংচুর করা হয়েছে। এ সব ঘটনায় মামলাও হয়েছে।
উপরোক্ত ধারাবাহিক ঘটনাবলীতে বারাকপুর ইউনিয়ন ক্রমাম্বয়ে অশান্ত হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকা জানতে চাওয়া হয় দিঘলিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ আহসানউল্লাহ চৌধুরীর কাছে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বারাকপুর ইউনিয়নে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। বর্তমানে ওই এলাকার পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্সে। এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা যারাই বিনষ্ট করবে, তারা এলাকায় যতই শক্তিশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক্ষেত্রে আমরা কোন দল, পেশি শক্তি বা প্রভাবশালীর কাছে নত হব না। তাছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশনা রয়েছে আমাদেরকে সঠিক এবং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের।
খুলনা গেজেট/এনএম

