২০০৯ সালে কানাডার অন্টারিওর টিমিনসে একটি ধাতুর খনিতে পৃথিবীর প্রাচীনতম পানির সন্ধান পান ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর ভূ-তত্ত্ব বিষয়ক অধ্যাপক বারবারা শেরউড ললার (৫৮) ও তার দল। বহু বছর ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় প্রাচীন বা পুরনো পানি নিয়ে কাজ করে আসছেন তিনি। অন্টারিওতে পাওয়া ওই পানি পরীক্ষা করার জন্য ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডে পাঠান তিনি।
বেশ কয়েক বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা জানান, পানির নমুনাটি অন্তত ১৬০ কোটি বছর পুরনো। সম্প্রতি ললারের একটি সাক্ষাৎকার ঘিরে এই নমুনার কথা ফের গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। কানাডিয়ান সাময়িকী মাসেলানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ললার জানিয়েছেন, নমুনাটি বিশ্লেষণ করে বিশ্বের অন্যতম একটি বড় রহস্য ঘিরে ধারণা পাওয়া যেতে পারে, সেটি হলো:মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা।
মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানে এই পানির তাৎপর্য
২৭০ কোটি বছর পুরনো মহাদেশীয় ভূ-ত্বক কানাডিয়ান শিল্ডে অবস্থিত কিড ক্রিক খনিতে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার গভীরে এই পানির নমুনাটি আবিষ্কার করেছিলেন শেরউড ললার। নমুনাটি নিয়ে তার গবেষণা ২০১৬ সালে ন্যাচার কমিউনিকেশন্স সাময়িকীতে প্রকাশ হয়।
এই আবিষ্কারকে মানব সভ্যতার জন্য ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা, এ থেকে পৃথিবীর উৎপত্তি ও গ্রহটিতে প্রাণের সৃষ্টি সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এখন মঙ্গল গ্রহেও প্রাণেও অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে নমুনাটি।
ললার ওই পানির সন্ধান পান এর তীব্র বাসি গন্ধের কারণে। তিনি মাসেলানকে বলেন, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ‘নাক অনুসরণ করে’ পাথরটির সন্ধান পেয়েছিলাম, যেটির ফাটল দিয়ে এই পানি বের হচ্ছিল। তিনি জানান, পৃথিবীর প্রাচীনতম এই পানিতে লবণের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি- সমুদ্রের পানির চেয়েও ১০ গুণ বেশি লবণাক্ত।
পরবর্তীতে ওই পানির নমুনা নিয়ে আরো গবেষণায় বিস্ময়কর আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। এতে মেলে প্রাণের অস্তিত্ব। এমন মাইক্রোব পাওয়া যায় যেগুলো খনির ভেতরের ওই পরিবেশে বেঁচে থাকার কথা নয়। বিজ্ঞানীরা জানান, নাইট্রোজেন ও সালফেট খেয়ে বেঁচে আছে মাইক্রোবগুলো। সাধারণত সমুদ্রের অতলে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে বাস করা প্রাণীদের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
প্রসঙ্গত, কানাডিয়ান শিল্ড হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম মহাদেশীয় ভূ-ত্বকগুলোর একটি। অতীতে সেখানে একটি অনুভূমিক সমুদ্রে তলপৃষ্ঠ ছিল। তবে সময়ের আবর্তনে ওই অনুভূমিক তলপৃষ্ঠ উল্লম্ব রূপ নেয়। বর্তমানে কিড খনির পাথরের দেয়ালে রয়ে গেছে এর চিহ্ন। সেখান থেকেই পানির নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন ললার।
লরার জানান, এই পানিতে হরেক রকমের দ্রবীভূত উপাদান, রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এসব রাসায়নিক উপাদান পৃথিবীর অন্ধকার, গভীর স্থানেও প্রাণের সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে।
মহাদেশীয় ভূ-ত্বক হওয়ায় কানাডিয়ান শিল্ড প্লেট টেকটনিক তৎপরতা অনেকটাই কম। মঙ্গল গ্রহের সাবসারফেস বা মাটির নিচের গঠনের সঙ্গে পৃথিবীর এই স্থানটির সাদৃশ্যই সবচেয়ে বেশি বলে বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভূপৃষ্ঠের আড়াই কিলোমিটার নিচে যদি জীবন-সমর্থনকারী পানি থাকতে পারে তাহলে মঙ্গল গ্রহেও এমনটা থাকা সম্ভব। নাসার পারসিভিয়ারেন্স রোভার বর্তমানে লাল গ্রহটিতে প্রাণের অস্থিত্বের সন্ধান করছে। নাসার অভিযানটিতে উদ্দীপনা যুগাতে পারে বিজ্ঞানীদের নতুন এই ধারণা।
এই গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কারের জন্য ২০১৯ সালে গেরহার্ড হার্জবার্গ কানাডা গোল্ড মেডাল ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং পুরস্কার পান ললার, যার আর্থিক মূল্য ১০ লাখ কানাডিয়ান সমমূল্যের। এছাড়া ২০১৬ সালে কানাডার ন্যাচারাল সায়েন্সেস অ্যান্ড রিসার্চ কাউন্সিল থেকে জন সি পোলানী পুরস্কার পান।
খুলনা গেজেট/এনএম