সুন্দরবনে হরিণ শিকার হঠাৎ করেই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চোরা শিকারিরা করোনার সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে বলে ধারণা স্থানীয় বয়স্কো নাগরিকদের। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১২ শিকারিকে হরিণের মাংস ও চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। পরে তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে স্মার্ট প্যাট্রোল এবং বন বিভাগের টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে শিকার কমছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে।
তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। আগে বন্যপ্রাণীর অংশ বিশেষ উদ্ধার হতো। আসামি আটক হতো না। এখন পুরস্কার ঘোষণার কারণে বন্যপ্রাণীর অংশসহ আসামি আটক হচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছে বন্যপ্রাণী শিকার বেড়েছে। আসলে নতুন বিধিমালার পর মানুষের সচেনতা বেড়েছে। এসব কারণে হরিণের মাংসসহ আটকের মাত্রা বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জানুয়ারি মাসের শেষ ১০ দিন ও চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই দিনে খুলনা ও বাগেরহাট সীমান্তে সুন্দরবন থেকে শিকার করে আনা চারটি মাথা, ১২০ কেজি মাংস, ১৯টি হরিণের চামড়া ও ১টি বাঘের চামড়া জব্দ করা হয়। এসময় আটক করা হয় ১২ জন শিকারি চক্রের সদস্যকে। বন বিভাগ, কোস্ট গার্ড ও পুলিশ সদস্যরা এ বন্যপ্রাণীর অংশসহ শিকারিদের আটক করে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, পেশাদার হরিণ শিকারিদের আছে বিশেষ সিন্ডিকেট এবং তাঁদের সঙ্গে থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীরা। সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা সুন্দরবনের গহীনে কেওড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান নিয়ে নৌকা, ট্রলার ও গাছে মাচা পেতে হরিণের গতিবিধি লক্ষ্য করে। হরিণ নদী ও খালের চরাঞ্চলে ঘাস খেতে আসে। শিকারিরা এসব স্থানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে। পরে তাদের নিযুক্ত এজেন্টের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার আবার কখনো মাংস এনে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে। করোনাভাইরাসের মধ্যে আগের মতো আবারও বেড়েছে সুন্দরবনে হরিণ শিকার।
সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা, শরণখেলা, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছাসহ বনের আশপাশ এলাকায় সবচেয়ে বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। এভাবে হরিণ শিকার করে বিক্রি করতে গিয়ে অনেকেই ধরাও পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। অনেক গ্রামে হরিণের মাংস নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে এবং এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে খুশি মনে হরিণের মাংস কিনছে বলে জানান স্থানীয়রা।
হরিণ শিকারের পর পাচারকারিরা বেশি দামে চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পথে-ঘাটে ধরাও পড়ে। ধরা পড়া ব্যক্তিদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছেড়ে দিয়ে অর্থ বাণিজ্য করছে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও পুলিশ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিও এ সব শিকারি চক্রের কাছ থেকে মুনাফা লুটছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে পাচারকারীদের আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী নিধন আইনে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু কোথাও এই শিকারি চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা গ্রামের বাসিন্দা আবেদ খান জানান, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবেও হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি আরও জানান, শিকারিদেরকে বন বিভাগের লোকজন চেনেন, কিন্তু তাদেরকে কখনো গ্রেপ্তার করে না।
মোংলা উপজেলার জয়মনি গ্রামের একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর্তৃপক্ষের কাছে চিহ্নিত হরিণ শিকারি এবং মাংস ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা থাকার পরও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। উল্টো, বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মচারীর সঙ্গে এসব শিকারি চক্রের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা। সম্প্রতি হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে, সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) পংকজ চন্দ্র রায় মুঠোফোনে খুলনা গেজেটকে বলেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকারে জড়িত কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়। এই শিকারি চক্রের সঙ্গে আরও কারা জড়িত আছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সুন্দরবনের প্রাণী ও বনজ সম্পদ রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে। বন রক্ষায় ও ওই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাণীশান্তা ইউপি চেয়ারম্যান সুদেব কুমার রায় বলেন, তিনি নিজেই হরিণসহ সুন্দরবন সুরক্ষার আন্দোলন করে আসছেন। প্রতিবাদমুখর থাকার কারণে তিনি অনেকেরই বিরাগভাজন হচ্ছেন। তারপরও তিনি থেমে নেই। তিনি আরও বলেন, শিকারিরা নিশ্চয়ই কারও না কারও ছত্রছায়ায় এ কাজে যুক্ত রয়েছে। যারা আটক হচ্ছে তারা সমাজের আরও বড় অপরাধীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে।
জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন খুলনা গেজেটকে বলেন, সম্প্রতি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিধিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তথ্য প্রদানকারীকে ৫০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার তথ্য প্রদানকারীকে ২৫ হাজার টাকা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হরিণের চামড়াসহ আটক করার সহায়তাকারীকে ২০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে হরিণের চামড়াসহ আটক করায় সহায়তাকারীকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্য প্রদানকারীর নিরাপত্তা ও তথ্য গোপন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার রোধে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।
তিনি জানান, সম্প্রতি বনের ভেতর ও সংলগ্ন এলাকায় বন্যপ্রাণী নিধন বেড়ে যাওয়ায় এ সতর্ক প্রদান করা হয়। পাশাপাশি বনরক্ষীদের টহল জোরদার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বনে ছোট ডিঙি নৌকা চলাচলের ওপরও সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়াসহ কোনো কোনো স্টেশন এলাকায় সব ধরনের পাস-পারমিট ইস্যু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট / এআর