বছরজুড়ে মহামারী করোনায় গেলবার বোরো আবাদে কিছুটা বিঘ্ন হয়েছিল। গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বোরো জমি ছাড়া এবার কৃষকরা আউশ ও আমন খেতেও আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এবার খুলনায় বোরোর ফলন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়। খুলনা জেলায় এ বছর ৫৭ হাজার ৫২০ হেক্টর জমি বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এর পরিমাণ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ।
মাঘের শুরুতেই বোরো আবাদের কাজে মাঠে নেমে পড়েছেন কৃষকেরা। ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালেই মাঠজুড়ে কৃষকরা বোরোর জন্য নির্ধারিত জমি ছাড়াও অনাবাদি হিসেবে পরিচিত আউশ ও আমন জমিতেও বোরোর চারা রোপণ করছেন। মাঠে মাঠে এখন বোরো রোপণের ধুম। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁরা। কৃষকেরা বললেন, দীর্ঘদিন ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার পর এবার আমনের দাম অনেকটা ভালোই পেয়েছি। সেই আশায় উৎসাহ-উদ্দীপনায় ফের বোরো আবাদ শুরু করেছি।
খুলনার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে মাঠে মাঠে চলছে বীজতলা ও ফসলি জমি প্রস্তুত করার কাজ। জমিতে জমিতে হাল চাষ, বীজতলা থেকে ধানের চারা ওঠানো এবং ধানখেতে চারা রোপণের কাজ চলছে। আগাম জমি প্রস্তুত করে কে কার আগে ধানের চারা রোপণ করবেন-এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে।
এদিকে মাঘের শুরুতেই তীব্র শীত থাকায় উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক দিনের টানা শৈত্যপ্রবাহে বোরো ধান আবাদে কৃষকেরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ধানের চারা পোড়া বা ঝলসানো রোগে মরেছে। কুয়াশাচ্ছন্ন এই আবহাওয়ায় রবি ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চাষাবাদে তাই বাড়তি যত্ন নেওয়া ও সতর্ক থাকা জরুরি। তীব্র শীতের কবল থেকে বোরো চারা রক্ষায় কৃষকদের জন্য পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
খুলনা জেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোরো আবাদ হয় ডুমুরিয়া উপজেলায়। জেলায় এ বছর ৫৭ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে বেরো আবাদ করা হয়েছে। তার মধ্যে ডুমুরিয়া উপজেলায় ২১ হাজার ৩শ‘ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। আর লবণাক্ত অঞ্চল দাকোপ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৮৫ হেক্টর জমিতে। এদিকে প্রত্যন্ত উপজেলা কয়রায় লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৪ হাজার হেক্টর, সেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হবে।
দাকোপ উপজেলার কাকড়াবুনিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই জানান, ‘গত আমন মৌসুমে ধানের ফলন এবং বাজারমূল্য ভালো পাওয়ায় চলতি বোরো মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছি। শীতে বীজতলায় একটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ধানের চারা রোপণের পর সে সমস্যা আর নেই। তবে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে খালের গেটের মুখ খুলে দিলে লবণ পানি ধানখেতে ডুকে ফলন নষ্ট হয়ে যাবে।’
গত বছরের বোরো ধানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ বছর নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন ডুমুরিয়া উপজেলার খামারবাটি গ্রামের কৃষক প্রশান্ত মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘১২ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। মাঠে ধানও মোটামুটি ভালো হয়েছিল। কিন্তু সেবার করোনার কারণে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না। ধান কাটতে গিয়ে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। গেলবার ধান চাষের খরচা তুলতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। সব ক্ষতি পোষাতে এ বছর আবারও বীজতলা তৈরি করে বোরো আবাদ করেছি।’
কয়েকটি উপজেলার অন্তত ২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর বোরো ধান লাগানোর পর মহামারী করোনার কারণে শ্রমিক সংকট, বাজার ব্যবস্থাপনা ধীরগতি ও নানা সমস্যায় বোরো চাষিদের কিছুটা বিঘ্ন পোহাতে হয়েছিল। তাই গেলবারের ক্ষতি পোষাতে এ বছরও চাষ করছেন তারা। কারণ এ বছর আমন ধানের দামও ভাল পেয়েছে। এছাড়া বোরো আবাদে খরচও বেশি হয়। বোরো ধান লাগানোর পর থেকে তিন-চারদিন পর পর সেচ দিতে হয়। তারা আশা করছে বোরো আবাদ করে বেশি লাভবান হবে।
দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘চলতি বোরো মৌসুমে এ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৫ হেক্টর। কিন্তু যেভাবে উপজেলাতে বোরো আবাদের বীজতলা দেখা গেছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ২৫০ হেক্টর জমিতে এ বছর বোরো চাষ হবে। বর্তমান চাষিরা বীজতলা থেকে ধানের চারা সংগ্রহ করে খেতে রোপণ করছেন। যেসব খেতে রোপণ করা হবে তা আগামী সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করেন তিনি।’
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন মুঠোফোনে খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘জেলার মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ বোরো চাষ হয় ডুমুরিয়ায়। এ বছর ডুমুরিয়ায় ২১ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ২১ হাজার ৩০৫ হেক্টর দাঁড়িয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধানের দর বৃদ্ধি থাকায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বোরো জমি ছাড়া এবার কৃষকরা আউশ ও আমন খেতেও বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এ উপজেলায় বোরো ধানখেতে ৯০ শতাংশ চারা রোপণ সম্পন্ন করেছে কৃষকরা।’
জানতে চাইলে খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘বীজতলা থেকে শুরু করে ধানখেতে বোরো আবাদ ভাল হয়েছে। এখনো পর্যন্ত বড় ধরণের কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। শীতে যদিও ছোট্টখাট্ট সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে তা কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আশা করি এ বছর বোরো আবাদ ভাল হবে, সঙ্গে কৃষকেরাও পাবে অধিক পরিমাণ ধান। সেই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা যা ধরা হয়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে।’
খুলনা গেজেট / এআর / এনএম