জন্মের পরে মাকে হারান। মা মারা যাওয়ার পর নানী চলে আসে তাদের সংসারে, তাকে দেখাশুনা করতে। সেই থেকে নানী ও দাদীর স্নেহের পরশে বড় হতে থাকে ইনুচ। একপর্যায়ে তার পিতা আবার বিয়ে করেন। ধীরে ধীরে ইনুচ বড় হতে থাকে আঠারোবেকী নদীর পাশে অবস্থিত তাদের নিজেদের বাড়িতে। বিয়ে করে সেখানেই তিনি সংসার করতে থাকেন। আর সৎ ভাইবোন নিয়ে পিতা চলে যায় সামন্তসেনায় অবস্থিত তাদের অন্য বাড়িতে।
নদীর তীরে ৪ বিঘা জমি নিয়ে আর বাঁশের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল ইনুচের সংসার। তবে নদী আস্তে আস্তে গিলে খেয়ে ফেলে তাদের চার বিঘা জমির সবটুকুই। নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে একপর্যায়ে তার সন্তানদের নিয়ে ঠাই হয় সরকারী রাস্তার পাশের ঝুঁপড়িতে। নদী ভাঙ্গনে সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারলো না পরিবার নিয়ে। আর একটু উপরে এসে ওই রাস্তার পাশের খাস জমিতে পুনরায় ঝুঁপড়ি বেধে ৩০ বছর ধরে বসবাস করছেন তিনি ও তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৬৫)। এরই মধ্যে তাদের সংসারে ৪ মেয়ে ও ২ ছেলে জন্মগ্রহন করে। সবগুলো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। আর বড় ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় থেকে হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের কাজ কওে, আর ছোট ছেলে চালায় ভ্যান। ছোট ছেলের ভ্যানটিও ভাড়ায় নেয়া। ঝুঁপড়ির পাশে আরেকটি ঘর বেধে মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে বসবাস করছে ছোট ছেলে ইসহাক। বড় ছেলে মাঝে মধ্যে এসে ছোট ভাইয়ের ওই কাঠের ঘরে একসাথে থাকেন। পরের ক্ষেতের বাঁশ কেটে বিভিন্ন হাটে বা ভ্যানে ফেরি করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে পার করেছে জীবনের অধিকাংশ সময়। বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে শরীর, তবে দমেনি এখনও ৮০ বছরের বৃদ্ধ ইনুচের মনের জোর। স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার তার। দু’জনের কোন রকমের আয় ও ছেলেদের সহযোগীতায় চলছে তার সংসার। ঝুঁপড়ির ভেতরে বসবাস করলেও অসুখী নন তিনি। সারাক্ষন থাকেন হাসিখূশি। জীবনে কখনও ভাবেননি পাকা ঘরে থাকবেন।
এমনই প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন পার করে জীবনের পড়ন্ত বেলায় ২ কাঠা জমিসহ একটি নান্দনিক ঘর পাচ্ছেন খুলনার রূপসা উপজেলার আঠারোবেকী নদীর তীরে ঝুঁপড়িতে বসবাসকারী ইনুচ শেখ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প আশ্রয়ণ-২-এর আওতায় মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে স্থায়ী ঠিকানা পাওয়ায় বেজায় খুশি তিনিসহ পুরো পরিবার।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায, প্রধানমন্ত্রী আগামী ২৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় সারাদেশে একযোগে উদ্বোধন করবেন গৃহহীনদের জন্য বরাদ্দকৃত সকল ঘর। প্রথম দফায় ইনুচের মত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন কাটানো খুলনার ৯২২ আশ্রয়হীন পরিবার পেতে যাচ্ছে স্বপ্নের আশ্রয়স্থল। পর্যায়ক্রমে এ জেলায় জমিসহ ঘর তৈরি করে দেয়া হবে ৫ হাজার ৮৮ টি গৃহহীন পরিবারকে। প্রথম পর্যায়ে রূপসা উপজেলায় ৭২টি, তেরখাদায় ৪০টি, দিঘলিয়ায় ৭০টি , ফুলতলায় ৪০টি, ডুমুরিয়ায় ১৪০টি, বটিয়াঘাটায় ১৫০টি, দাকোপে ১৪০টি, পাইকগাছায় ২২০টি ও কয়রা উপজেলায় ৫০টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের নিবীড় তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা আশ্রয়হীন মানুষের স্বপ্নের ঠিকানা এসব ঘর নির্মাণ কাজ শেষের পথে। গৃহহীনদের স্বপ্নের পূর্ণতা পাওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
আরও জানা যায়, প্রতিটি গৃহনির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। সে হিসেবে ঘর নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা। প্রতিটি গৃহে ইটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং রঙিন টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটি কক্ষ, একটি রান্না ঘর, টয়লেট ও সামনে খোলা বারান্দা থাকবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জিয়াউর রহমান পিএএ খুলনা গেজেটকে জানান, “মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী যারা ভূমিহীন ও গৃহহীন রয়েছে তাদেরকে ঘর তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। খুলনা জেলায় ৫ হাজার ৮৮টি ঘরের মধ্যে প্রথমপর্যায়ে ৯২২টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গুণগতমান যথাযথ বজায় রেখে দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ঘরগুলোর নির্মাণ কার্যক্রম শেষের পথে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গুণগতমান বজায় রেখে গৃহহীনদের একটা মানসম্মত ও টেকসই ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য আমরা সর্বাতœক চেষ্টা করছি।”
খুলনা গেজেট/এমএম