কয়েক দিন হলো সারা মক্কা জুড়ে অন্যরকম এক খুশির আমেজ বিরাজ করছে। কারো খাওয়া ঘুম নেই। পবিত্র ঘর কাবা শরীফের পূর্ণ নির্মাণের কাজে ব্যস্ত সবাই। কি যুবক, কি বৃদ্ধ! বসে নেই বাচ্চারাও! পুরুষদের কাজে যদ্দুর সম্ভব সহযোগিতা করছে মহিলারা। এমন পূণ্যের কাজে কি পিছিয়ে থাকতে চায় কেউ!
কাবা ঘর। আল্লাহর ঘর। আরবের সৌরভ। মক্কা বাসীর গৌরব। এই ঘরই তো তাদের ঐতিহ্যের প্রতিক। বংশ পরম্পরায় তারাই এ ঘরের প্রতিবেশি। সুতরাং এ ঘরের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ মক্কাবাসীর কর্তব্যের শামিল।
সিদ্ধান্ত হলো কারা কি কাজ করবে! কেউ পাথর বয়ে আনছে, কেউ বা স্বযত্নে পাথরগুলি ধুয়ে পরিস্কার করে দিচ্ছে। পাথরে পাথরে মিলিয়ে সুন্দরভাবে স্থাপন করাটা দুঃসাধ্য হলেও অসাধ্য নয়। নিপুণহাতে সে কাজটিও আঞ্জাম দিচ্ছে একদল দক্ষ লোক।
হাতে ধরে পাথর বহন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। তবে কোন কাপড়ের উপর পাথর রেখে কাধের উপর বহন করা তুলনামূলক সহজ। বেশীরভাগ লোকই তাই করছে। নিজের পরণের লুঙ্গি খুলে তাতে করেই পাথর বহন করছে। এ সমাজে এটা তেমন কোন ব্যাপার না। যত্রতত্র কাপড় খুলে উলঙ্গবস্থায় চলাফেরা করা কেউ বাঁকা চোখে দেখে না। মুর্খতা ও জাহেলিয়্যাতের ঘোরে নিমজ্জিত এ সমাজ, লাজ-শরমের মাথা খুইয়ে বসেছে অনেক আগেই।
পাথর বহনকারীদের মধ্যে শামিল আছেন মক্কার গণ্য মান্য অনেকেই। আছে কিশোর এবং যুবকরাও। তবে সবাই নিজ নিজ পরিধেয় বস্ত্র খুলে তাতে করেই পাথর বহন করছে। ব্যতিক্রম কেবল একটি বালক। বয়স তাঁর পঁনেরোর কোঠা পেরোয় নি এখনো। হাতে করে পাথর বহন করতে ওর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তথাপি তার পরনে লুঙ্গি আছে ঠিকই। চাইলে সেও অন্যদের মত পরনের কাপড় খুলে পাথর বহন করতে পারতো। কিন্তু শত কষ্ট হলেও সে তার আব্রু অনাবৃত করতে নারাজ।
দূর থেকে বিষয়টি দৃষ্টি কেড়েছে আব্বাসের। কুরাইশের সর্বজন বিধিত সম্মানিত মানুষ। ছোট বালকের এমন আচরণে তিনি কিছুটা কৌতুহলী হলেন। কে এই কিশোর? এই বয়সেই এতো আত্মসম্মানী সে । ধীর পায়ে বালকের কাছে এগিয়ে গেলেন আব্বাস। ও আচ্ছা! এ যে তার নিজের ভাতিজা। কলিজার টুকরা মুহাম্মাদ।
এ জমিনে এমন ছেলে একটাই। মক্কার আল-আমিন। ছোটদের প্রাণের প্রিয়। বড়দের নয়নের মনি। ওর পক্ষেই সম্ভব এমন প্রতিকূল শ্রোতেও অবিচল থাকা। মানব শ্রেষ্টত্বের অন্যতম ভূষণ লজ্জা। এতো সহজে এ শ্রেষ্টত্ব ম্লান হতে দেওয়ার মত ছেলে সে নয়। আব্বাস এসব ভাবতে ভাবতে ভাতিজা মুহাম্মাদের সামনে এসে দাড়ালো।
চাচার দিকে এক পলক চেয়ে আবার মাথা নিচু করে নিলো মুহাম্মাদ। একে তো সম্মানিত চাচা অপরদিকে তার স্বভাবজাত মুরুব্বীবোধ তাকে আব্বাসের চোখে চোখ রাখার অনুমতি দিলো না। আয়ত-নয়েন চাচার দিকে নিবিষ্ট হলো সে। কেবল তার আদেশের অপেক্ষায়।
কি ভাতিজা! এতো কষ্ট করার কি আছে? লুঙ্গি খুলে কাধে করে পাথর নিলেই তো পারো। আব্বাস একটু মজা করেই কথাগুলো বললেন।
দেখছো না, সবাই কেমন লুঙ্গি খুলে সহজে পাথর বহন করছে। তুমি তো ছোট মানুষ।
চাচার কথাগুলি যেন ভাতিজার কানে বজ্রাঘাতের ন্যায় পতিত হলো। কিন্তু পিতৃতুল্য চাচার কথা অবহেলা করারও সাধ্য ছিলনা তার। লুঙ্গির বাধনে হাত রেখেছেন মাত্র। কিছুটা খোলাও হয়েছে।
কিন্তু এতোগুলি মানুষের সামনে কিভাবে পরণের কাপড় খুলবো! কেমন দেখাবে আমাকে! ছিঃ কি লজ্জা। কথাগুলো ভাবতেই বেশামাল হয়ে পড়লো কিশোর মুহাম্মাদ। কিছু বুঝে উঠার আগেই ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন। সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো তার পবিত্র চিত্ত। চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থির হয়ে রইলো।
দীর্ঘক্ষণ পর তার নিথর দেহে হুশ ফিরে এলো। চারপাশে তাকিয়ে নিজেকে আবিস্কার করলেন মরুভূমির ধুলিতে। উলঙ্গ হওয়ার আতংক তখনো তাকে পীড়া দিচ্ছিলো। মুখে বলছিলেন, আমার পরনের কাপড় দাও? আমার লুঙ্গি দাও। (সহিহ বুখারী- ১৫৮২ নং হাদিস অবলম্বনে)
খুলনা গেজেট/এনএম