খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সাবেক প্রধান বিচারপতির মৃত্যুতে আজ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ
  সিইসিসহ নতুন নির্বাচন কমিশনারদের শপথ আজ
  অ্যান্টিগা টেস্ট: ৪৫০ রানে ইনিংস ঘোষণা ওয়েস্ট ইন্ডিজের, দ্বিতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ ৪০/২

কুরবানীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম-কানুন

মুফতি মাহফুজুর রহমান

কুরবানী ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এটি এমন এক ইবাদত যার সূচনা হযরত আদম (আঃ) থেকে হয়েছে। আল-কুরআনুল কারীমের সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে হযরত আদম আঃ এর দুই পুত্রের কুরবানী করার ঘটনা দ্বারা এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্যেক নবীর যুগেই কুরবানী ছিল। তবে তার পদ্ধতি ও ধরণ এক ছিল না । কুরবানী করা সামর্থবান মুসলমানের উপর ওয়াজিব।

এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি কুরবানী করার সামর্থ্য রাখে অথচ কুরবানী করেনি, সে যেন আমাদের ঈদগাহে উপস্থিত না হয় (বায়হাকী ১৯৫৪১, মুসতাদরাকে হাকেম ৭৭২৮)। হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন মানুষ কুরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করা (অর্থাৎ কুরবানী করা) থেকে আল্লাহর কাছে প্রিয় কোন আমল করতে পারে না। নিশ্চয় কুরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং পশম ও খুরসহ আসবে। নিশ্চয়, কুরবানীর পশুর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বে তা আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হয়ে যায়। তাই তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী কর (সুনানে তিরমিযী ১৪৯৮)। তবে কুরবানীর মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত শুদ্ধ হবার জন্য কিছু নিয়মকানুন আছে। এ বিষয়ে এখানে কিছুটা আলোকপাত করা হলো।

কুরবানী কার উপর ওয়াজিব?

  • প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ্ব্ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার উপর কুরবানী করা ওযাজিব। টাকা-পয়সা, সোঁনা-রুপা, অলঙ্কার, ব্যবসা ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনোতিরিক্ত বাড়ি/ঘর, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। আর নেসাব হল, সোঁনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি, টাকা ও অন্যান্য বস্তুর নেসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর কারো যদি মালিকানায় সোঁনা, রুপা, টাকা বা প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ এর কোনটিই পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না হয় কিন্তু কয়েকটি মিলে নেসাব পরিমাণ হয়। তাহলে তার উপর ও কুরবানী করা ওয়াজিব।
  •  যদি কারো ফ্ল্যাট বা ঘর থাকে যা তার বসবাসের প্রয়োজনে লাগে না, অথবা এর ভাড়ার উপর তার সংসার চলা নির্ভরশীল নয়, তাহলে এটার মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয় তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
  •  বিলাস জাতীয় পণ্য সামগ্রী এবং টেলিভিশন, ডায়মন্ড, হীরক, মুক্তা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তুর্ভুক্ত নয়। এগুলোর মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব।
  • কারো বসবাস অথবা খোরাাকির প্রয়োজনে আসে না এরকম সামান্য এক খন্ড জমি থাকলেও তার মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয় তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
  • কারো মালিকানায় দোকান থাকলে এবং দোকানের ভাড়ার উপর তার সংসার নির্ভরশীল না হলে দোকানের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
  • পরিরবারের একাধিক সদস্য নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেকের জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে এক ভাগ কুরবানী করার দ্বারা সবার কুরবানী আদায় হবে না।
  • কোন অমুসলিম কুরবানীর দিনগুলিতে ইসলাম গ্রহণ করলে তার কাছে নেসাব পরিমাণ প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ থাকলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
  • কুরবানীর দিনগুলোতে কেউ সফরে থাকলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। তবে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্বে সফর থেকে ফিরে আসলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে।
  • দরিদ্র ব্যক্তি যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় কুরবানীর পশু কেনার পর সফরে বের হলেও তার জন্য ঐ পশু কুরবানী করা ওয়াজিব।
  • স্বামীর কাছে নগদে পরিশোধেয় মহর পাওনা থাকলে এবং স্বামী ধনী হলে তা নেসাব পরিমাণ হলে মহিলার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।
  • মহর নগদে পরিশোধেয় না হলে কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।
  • নিজ শহরে কুরবানীর জন্তু পাওয়া না গেলে, যেই শহরে পাওয়া যায় সেখান থেকে পশু এনে কুরবানী করা জরুরী।
  • পাগল সম্পদশালী হলেও তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
  • মৃত্যু সংকটাপন্ন ধনী ব্যক্তির বিগত অনাদায়ী বছরগুলোর কুরবানীর জন্য (যা তার উপর ওয়াজিব ছিল অথচ আদায় করেনি) এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে প্রত্যেক বছরের জন্য একটি করে ছাগলের মূল্য সদকা করার ওছিয়াত করে যাওয়া ওয়াজিব।
  • দরিদ্র ব্যক্তি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে সেটি কুরবানী করা আবশ্যক। তা বিক্রি করা বা পরিবর্তন করা অথবা পূর্বের থেকে নিয়ত করে না থাকলে শরীক নেয়া জায়েয নেই।
  • পিতার মৃত্যুর পরে যদি সন্তানরা এক সাথে কাজ কর্ম করে থাকে, আর তাদের যৌথ সম্পদ বণ্টন করার পরে যদি প্রত্যেকে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে সকল সাবালক সদস্যের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানী ওয়াজিব হবে।
  •  নাবালেগ সন্তান সম্পদশালী হলেও তার পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়া তার পিতার উপর ওয়াজিব নয় আর নাবালেগের সম্পদ থেকে কুরবানী দেয়া তার পিতার জন্য বৈধ নয়।

কুরবানী কখন করা উত্তম ?

  •  কুরবানীর সময় তিনদিন । অর্থাৎ জিলহজ্ব মাসের ১০,১১,১২ তারিখ। তবে প্রথম দিন কুরবানী করা উত্তম (সুনানে বায়হাকী ১৯৭৯৩)।
  • যেখানে ঈদের নামাজ ও জুমআর নামাজ ওয়াজিব সেখানে ঈদের নামাজ আদায় হওয়ার পূর্বে কুরবানী করা জায়েয নেই। হাদীস শরীফে এসেছে বারা বিন আযেব রাঃ থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন খুৎবা দিলেন। তিনি বললেন, আজকের দিনে প্রথমে আমরা নামায পড়ি। এরপর ফিরে এসে জবাই করি। যারা এভাবে করবে, তারা আমাদের তরিকা মত আমল করল। আর যে ব্যক্তি নামাযের পূর্বে জবাই করবে, সেটি হবে তার পরিবারের খাবার গোস্ত, তা কুরবানী হবে না (সহীহ বুখারী ৫৫৪৫, সহীহ মুসলিম ১৯৬৫)।
  • শহরের কোন এক স্থানে ঈদের নামায আদায় করা হয়ে গেলে ঐ শহরের সব স্থানেই কুরবানী করা জায়েয আছে।
  • বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে ১০ জিলহজ্ব ঈদের নামাজ আদায় না করা গেলে ১০ তারিখ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে কুরবানী করা যাবে।
  • ১০ই জিলহজ্ব কুরবানী না করলে ১১ জিলহজ্ব ফজরের পরে কুরবানী করতে পারবে। নামাজের পর খুৎবার পূর্বে কুরবানী করা জায়েয আছে তবে খুৎবার পরে কুরবানী করা উত্তম।
  • জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ তারিখ দিবাগত রাতে কুরবানী করা জায়েয আছে তবে রাতে কুরবানী করা মাকরুহ।
  • যেখানে কুরবানী দেওয়া হচ্ছে সেখানের সময় ধর্তব্য, কুরবানী দাতার অবস্থান স্থানের সময় ধর্তব্য নয়।
  • ঈদের নামায পড়ে কুরবানী করার পরে জানা গেল ইমামের ওজু ছিলনা। তাহলে সেক্ষেত্রে কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে নামায পুনরায় পড়তে হবে।
  • যেখানে ঈদের নামাজ ও জুমআর নামাজ ওয়াজিব নয় সেখানে ১০ তারিখে ফজরের পর কুরবানী করা জায়েয আছে (সহীহ বুখারী ২/৮২৭)।

শরীকানা কুরবানির নিয়ম:

  • একটি গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারে। হাদীস শরীফে এসেছে, জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুদায়বিয়াতে একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে এবং একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছি (সহীহ মুসলিম ১৩১৮)।
  • জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, একটি গরু সাত জনের পক্ষ থেকে ও একটি উট সাত জনের পক্ষ থেকে দেয়া যায় (আবু দাউদ ১৮০৮)।
  • জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ্ব ও ওমরায় প্রত্যেক সাত জনে একটি উটে শরীক হয়েছি।… তিনি বলেন, সেদিন আমরা সত্তরটি উট কুরবানী করেছি। আমরা প্রত্যেক সাতজন একটি উটে শরীক হয়েছি (সহীহ মুসলিম ১৩২১)।
  • সাতের নীচে জোড় বেজোড় যে কোন সংখ্যায় শরীক নেওয়া জায়েয আছে ।
  • কোন শরীকের অংশ এক সপ্তমাংশের কম হলে কারো কুরবানী আদায় হবে না।
  • পশু ক্রয়ের পূর্বে শরীক নেয়া ভাল। পশু ক্রয়ের পরেও ধনী হলে শরীক নেওয়া জায়েয আছে। তবে ঐ টাকাটা সদকা করে দেওয়া উত্তম। এক্ষেত্রে পশু ক্রয়ের সময়ই শরীক নেওয়ার নিয়ত করা উত্তম।
  • দরিদ্র ব্যক্তি কুরবানীর জন্য পশু ক্রয় করলে ক্রয়ের পরে তাতে অন্য কাউকে শরীক নেওয়া বৈধ নয়। তবে ক্রয়ের সময় শরীক নেয়ার নিয়ত করলে শরীক নিতে পারবে।
  • শরীকানা কুরবানীতে সব শরীকেরই ইবাদতের নিয়ত থাকতে হবে, যদি কোন শরীক গোস্ত খাওয়া বা ইবাদত ছাড়া অন্য কিছুর নিয়ত করে তাহলে কারো কুরবানী আদায় হবে না।
  • শরীকদের মধ্যে যদি কোন শরীকের টাকা অবৈধ হয় তাহলে কারো কুরবানী আদায় হবে না।
  • পশু ক্রয়ের পর যদি কোন এক শরীক মারা যায় এবং বালেগ ওয়ারেছগণ কুরবানীর অনুমতি দেয় তাহলে সকলের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।
  • মায়্যেতের ওয়ারেছদের অনুমতি ছাড়া কুরবানী করলে কারো কুরবানী আদায় হবে না।
  • যদি কোন শরীক তার অংশ দ্বারা আকীকা, ওলীমা বা অন্য কোন ইবাদত করার নিয়ত করে তাহলেও সকলের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।
  • যদি কিছু শরীক পূর্বের বছরের কুরবানীর নিয়ত করে, আর কিছু শরীক এই বছরের কুরবানীর নিয়ত করে, তাহলে যারা এ বছরের নিয়ত করেছে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। যারা পূর্বের বছরের নিয়ত করেছে তাদের কুরবানী নফল হবে, তবে পুরো গোস্ত ছদকা করে দিতে হবে।
  • একটি ছাগল, ভেড়া, দুম্বা যত বড়ই হোক একজনের পক্ষ থেকেই কুরবানী দেয়া যাবে।
  • কোন শরীক অমুসলিম হলে কারো কুরবানীই সহীহ হবেনা।
  • কোন শরীক মৃত্যু বরণ করলে তার ওয়ারিছদের থেকে ঐ অংশ ক্রয় করে অন্য কেউ পশুতে শরীক হতে পারবে।
  • কয়েক শরীক মিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে এক ভাগ কুরবানী করা জায়েয আছে।
  • কয়েক শরীক মিলে একটি পশু ক্রয় করলে কোন শরীকের জন্য অপর শরীকদের অনুমতি ব্যতীত পশুটি বিক্রয় করা জায়েয নেই। অনুরুপভাবে কারো অনুমতি ব্যতিত তাকে বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে অন্য কাউকে নেয়া জায়েয নেই
  • সাত শরীকের কোন শরীক যদি তার ভাগের চেয়ে বেশি টাকা এমনিতে দেয়, সে এক সপ্তমাংশের থেকে বেশি অংশের মালিক হবে এজন্য নয় তাহলে তা জায়েয আছে ।

(লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, দারুল উলূম খুলনা; ইমাম ও খতীব, নিরালা জামে মসজিদ, খুলনা)

 

খুলনা গেজেট / এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!