বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি বধ্যভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গল্লামারী ময়ূর নদ’র তীরে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তর পাশে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে গল্লামারী ছিল এক আতঙ্কের নাম । শহরের অদূরবর্তী এই জায়গাটি ছিল বেশ নির্জন, তখন এটি ছিলো রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্র। পাকবাহিনীর কিছু সদস্য কেন্দ্রটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। নির্জনতা এবং পাশে বয়ে চলা নদীর কারণেই এই স্থানকে গণহত্যা ও বধ্যভূমির জন্য বেছে নেয়া হয়। নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে বেতার ভবনে আটকে রাখা হতো। নির্যাতনের জন্য ভবনের পেছনের একটি দোচালা ঘর ও সামনের চত্বর ব্যবহার করা হতো। মৃত্যু নিশ্চিত হলে লাশগুলো ফেলে দেয়া হতো সামনে বয়ে যাওয়া নদীতে এবং নির্জন জায়গাটিতে। প্রথম দিকে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন শেষে গুলি করা হতো, কিন্তু পরে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি খরচ না করে গলা কেটে হত্যা করতো ।
১৭ ডিসেম্বর খুলনা শহর মুক্ত হবার পর স্বজনহারা মানুষ ছুটে আসে গল্লামারী বধ্যভূমিতে আপনজনদের লাশ খুঁজে পেতে। এ বধ্যভূমির তখনকার অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর গ্রন্থের লেখক সুকুমার বিশ্বাস। তিনি লিখেছেন, ‘ছবি তুলবার জন্য গল্লামারীর অভ্যন্তরে ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে সেদিকে। একটি কুকুর খাচ্ছে আর দূরে অপর একটি লাশের পাশে আর একটি কুকুর বসে হাঁপাচ্ছে। মনে হয় মানুষ খেয়ে তার উদর অতিমাত্রায় পরিপূর্ণ ।’ (মুক্তিযুদ্ধে খুলনা, মোল্লা আমীর হোসেন, ১৭৬ পৃষ্ঠা)
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রশাসনিক ভবনটি ছিল একতলা বেতারকেন্দ্র, যা ছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম ভয়াবহ টর্চার সেল। সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের ৩০ বছর পূর্ণ করলো। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে ৪ টি ডিসিপ্লিনে ৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়, তার বর্তমান ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সাত হাজার, আর ডিসিপ্লিন ২৯টি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমিতে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ঠিক কতো লোককে হত্যা করেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। এ নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোন গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায়নি। তবে অমল কুমার গাইনের লেখা ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ : খুলনা জেলা’ বইয়ের ৯৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, “গল্লামারীতে প্রায় প্রতিদিন গণহত্যা চালানো হতো। সে হিসেবে ধরলে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে কমপক্ষে ২৫০ টি গণহত্যা হয়েছে। কয় হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে তা না জানলেও আনুমানিক সে সংখ্যা ১০ হাজারের কম হবে না।”
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস খুলনা গেজেটকে জানান, “একাত্তরের বধ্যভূমির উপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে পবিত্র ভূমি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে গ্রাজ্যুয়েশন শেষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি দেশ ও দশের সেবায় নিয়োজিত হয় তাহলে হয়তো আমরা কিছুটা হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ শোধ করতে পারবো।”
খুলনা গেজেট / এমএম