রবিবার । ১৬ই নভেম্বর, ২০২৫ । ১লা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২
বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরিতে চ্যালেঞ্জ

অধিকার আর সম্মানের সঙ্গে বাঁচার স্বপ্নের খোঁজে হিজড়ারা

আয়শা আক্তার জ্যোতি

“আমরা যারা হিজড়া, সমাজের সাধারণ মানুষ আমাদের সহজে মেনে নিতে পারে না। কারণ সমাজের অবহেলা উপেক্ষা করে চলা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য খুব কষ্টকর। যখন আমার বাবা বাজারে যান, তখন মানুষ তাকে দেখিয়ে বলে-‘ওই যে হিজড়ার বাবা যাচ্ছে’। আবার আমার ভাই যখন কলেজে যায়, তখন সবাই বলে-‘ওটা হিজড়ার ভাই’। এমনকি আমার বোনেরও ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না- এই কথাগুলো আমাদের শুনতে হয়। আমি চাই না, আমার কারণে আমার পরিবারকে কেউ কটু কথা শোনাক। কোনো সান্ত্বনা চাই না, শুধু চাই সম্মান নিয়ে বাঁচতে। এসব কারণেই আমরা অনেকেই পরিবার ছেড়ে চলে যাই।” এভাবেই নিজের মনের মধ্যে জমে থাকা অভিযোগগুলো এই প্রতিবেদকের কাছে ব্যক্ত করেছেন খুলনার হিজড়া সাদিয়া।

সাদিয়া আরও বলেন, “আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন সহজে হাসপাতালে সেবা পাই না। অনেক সময় চিকিৎসা নিতে হলে ডাক্তার বা কর্মীদের হাতে-পায়ে ধরতে হয়। কখনও কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে নিতে হয়, যাতে তারা সেবা দেয়। তখন তিনি বলে-‘ওরা টাকা দেবে তো?’ তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেবা দেওয়া হয়। আমরাও সবার মতো নির্ধারিত ফি দিয়ে চিকিৎসা নিতে চাই। কিন্তু সেখানেও আমাদের অবহেলার শিকার হতে হয়। যদি সাধারণ মানুষের মতো আমাদেরও সমান গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের জন্য তা অনেক স্বস্তির হতো।”

শুধু যে স্বাস্থ্য সেবা আর কটু কথায় থেকে থাকে তা নয়, হিজড়া রিয়ার কথায়, “ভালো জায়গায় কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না।”

হিজড়া রিয়া বলেন, “সবাই বলে- ওরা তো হিজড়া, ওরা নিয়মিত ভাড়া দেবে না, প্রতি মাসে ঝামেলা করবে। যদি বাবা-মা গ্রহণ করে নেয় এবং পরিবারের নিজস্ব জায়গা-জমি থাকে, তাহলে সেখানে থাকা যায়। কিš তাদের মনের মধ্যে সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করে। এক কথায়, হিজড়া মানেই সমাজের চোখে আতঙ্ক।”

তিনি আরও বলেন, “যাদের পরিবার মেনে নেয় না, তারা গুরু মায়ের কাছে আশ্রয় নেয়। গুরু মা তখন নিজের জায়গায় তাদের রাখেন, কিন্তু সেখানেও থাকা খুব কষ্টের। অল্প জায়গায় অনেককে একসাথে থাকতে হয়। যাদের পরিবার মেনে নেয় না, তাদের জন্য যদি সরকার বা কেউ ভালোভাবে থাকার ঘর বানিয়ে দিত, তাহলে আমরাও সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারতাম।”

রিয়া আরও বলেন, “আমরা তো জন্মের পর স্বাভাবিক সব শিশুদের মতোই থাকি। সবার সঙ্গে খেলাধুলা করি, স্কুলেও যাই। সবকিছু ঠিকঠাকই চলে। কিন্তু যখন আমাদের শরীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে, তখনই সমস্যা শুরু হয়। ক্লাসে সহপাটীরা পাশে বসতে চায় না, অন্যদের সঙ্গে মিশে খেলতেও দেয় না। শিক্ষকরা পর্যন্ত আমাদের আলাদা চোখে দেখেন। সবাই যখন আমাদের ভিন্নভাবে দেখে, তখন স্কুলে যেতে আর ভালো লাগে না। এসব কারণেই আমাদের দিয়ে পড়াশোনাটা আর হয়ে ওঠে না।”

শিক্ষা ও চাকরির বিষয়টি তুলে ধরে রিয়া বলেন, “দেখেন, আমরা যেখানে ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে পারি না, সেখানে আমাদেরকে কীভাবে সরকারি চাকরি দেবে? আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী যদি চাকরির সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে ভালো হয়।”

কথা হয় হিজড়া রিয়ার মা হাসিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ছোট থাকতে রিয়া খুব সাঁজগোজ করত, নাচ-গান করতে পছন্দ করত। যখন ধীরে ধীরে ওর মধ্যে পরিবর্তন আসতে থাকে, তখন আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ডাক্তার জানান-হরমোনের পরিবর্তনের কারণেই এমন পরিবর্তন হচ্ছে। ও আর আগের অবস্থায় ফেরত আসবে না। যতই মারধর করুন, কোনো লাভ হবে না। অকারণে অত্যাচার করে লাভ নেই। চিকিৎসা করা যেতে পারে, কিন্তু ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আমরা চিকিৎসা করেছিলাম। কিš কোনো পরিবর্তন না দেখে চিকিৎসা বন্ধ করে দেই।”

তিনি আরও বলেন, “রিয়া যখন ক্লাস এইটের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছিল, একদিন পরীক্ষা দিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ৮-৯ বছর পর আমার বড় ছেলের মেয়ে হলে রিয়া বাড়িতে ফিরে এলো। এখন আমাদের সাথেই থাকে। সকালে ওদের সঙ্গে বাইরে যায়, রাতে বাড়ি ফিরে আসে।”

রিয়ার প্রতিবেশী শান্ত বলেন, “ও তো আমাদের সামনেই বড় হয়েছে। দেখতাম, ও হেলে-দুলে হাঁটত, নাচ করত, মেয়েদের মতো সাঁজগোজ করত। এটা দেখে আমরা হাসাহাসি আর মজা করতাম। এক কথায়, সবাই ওকে হাসির পাত্রে পরিণত করেছিল। ও মূলত ব্যঙ্গ- বিদ্রুপের শিকার হয়েছিল, যার কারণে মন ভেঙে গিয়ে বাসা থেকে চলে যায়। প্রায় আট-নয় বছর পর ও আবার বাড়িতে ফিরে আসে। এখন সে তার ভাইদের সঙ্গে মিলে পরিবারের দায়িত্ব সামলাচ্ছে।”

খুলনার নক্ষত্র যুব মানবকল্যাণ সংস্থার সভাপতি পাখি দত্ত বলেন, “খুলনায় শুধু হিজড়া রয়েছে ২১০ জন। আমরা খুবই দূরাবস্থায় রয়েছি। আবাসন নেই, কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চায় না। জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা হয়নি। এছাড়া কর্মসংস্থানের সমস্যা প্রকট। এখনো বাচ্চা নাচিয়ে পেট চালাতে হয়। লেখাপড়ার সুযোগ কম। হিজড়া শিশুরা যাতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে পারে। কটু কথা শুনতে না হয়। আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকরা দূর করতে হবে।”

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি খুলনা বিভাগীয় মিডিয়া কমিটির আহ্বায়ক খলিলুর রহমান সুমন বলেন, “আমাদের সমাজে ওদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা এখনো অনেক বেশি এবং তা দৃশ্যমানও। কিন্তু অন্তরের খবর জানতে হলে ওদের কাছেই যেতে হয়। ওদের ইতিবাচক দিকগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সমাজের অন্য সবার মতো ওরাও মানুষ- এই বিষয়টি বোঝানোর জন্যই আমরা কাজ করছি। প্রতিবছরের মতো এ বছরও আমরা তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করব। একই সঙ্গে ওদের স্থায়ী আবাসনের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেব।”

জানা গেছে, “ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সম্মিলিত ভাবে “Expanding civic space through active CSO participation and strengthened governance system in Bangladesh (ECSAP)” নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক নারী, দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

খুলনার জেলা প্রশাসক মোঃ তৌফিকুর রহমান বলেন, “আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো আবেদন পাইনি। সহযোগিতা চাইলে সরকারিভাবে আমরা সহযোগিতা করে থাকি। আর থাকার ব্যবস্থা করার জন্য যদি কোনো আবেদন করে থাকে, তাহলে দেখব এখানে ব্যবস্থা করার মতো কোনো জায়গা আছে কিনা অথবা সরকারি কোনো সম্পত্তি আছে কিনা যেখানে ওনাদের (হিজড়া) রাখা যায়। যদি তারা আমাদের কাছে আসেন, তাহলে আমরা তাদের জন্য ব্যবস্থা করব।”

তিনি বলেন, “শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমরা সহযোগিতা করে থাকি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেগুলোতে আমরা তাদের যুক্ত করতে পারব। এছাড়া স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মনে হয় না তারা কোনো সমস্যায় পড়ার কথা। কারণ চিকিৎসার জন্য গেলে স্বাস্থ্য বিভাগ সহযোগিতা করে। আর যদি মনে হয় চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না, তাহলে আমাকে জানালে সেটা নিশ্চিত করব।”

হিজড়াদের চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সরকারের বিভিন্ন পলিসি রয়েছে, তাদের জন্য কোটা থাকে আর মেধা তালিকায় থাকলে কোনো বাধা নেই। যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করে কোয়ালিফাই হলে অবশ্যই চাকরি পাবেন।”

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন