বুধবার । ৫ই নভেম্বর, ২০২৫ । ২০শে কার্তিক, ১৪৩২
পদ্ম বিলের খাল ইজারা না দেয়ার দাবি চাষীদের

রূপসায় ঘেরের পাড়ে সবুজ বিপ্লব

এস এম মাহবুবুর রহমান

বিশাল বিল জুড়ে মাছের ঘের। কিন্তু বিলের যে-কোনো প্রান্ত থেকে দৃষ্টি দিলে ঘেরের জলাশয় চোখে পড়ে না। দৃষ্টি যতদূর যায় সবুজ আর সবুজ। প্রতিটি মাছের ঘেরের বেড়িতে কোনো না কোনো ফল ও সবজির চাষ করা হচ্ছে। এ দৃশ্য রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের আনন্দনগর বিলের। শুধু আনন্দনগর বিল নয়, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের প্রতিটি বিলের মাছের ঘেরের বেড়িতে এভাবেই ফল ও শাকসবজির চাষ করে বাড়তি আয় করছেন কৃষকরা।

গত কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলের ঘেরের বেড়িতে ব্যতিক্রম ফল হিসেবে অফসিজিনের তরমুজের চাষ করা হলেও এ বছর অনেকেই তরমুজের পাশাপাশি সৌদি আরবের রকমিলন বা সামমাম চাষ করেছে। ফলনও হয়েছে বাম্পার। অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন এসব কৃষকরা। তাদের মধ্যে একজন আনন্দনগর গ্রামের চাষি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ৫বিঘার মাছের ঘেরের বেড়ীতে প্রথমবারের মত সৌদি আরবের সুস্বাদু ফল সামমাম ও অফসিজনের তরমুজ চাষ করেছেন। যদিও তরমুজ ফলন এখন শেষ পর্যায়।

চাষি জাহাঙ্গীর হোসেন খুলনা গেজেটকে বলেন, প্রতিবছর ঘেরের বেড়িতে অফসিজনের তরমুজসহ অন্যান্য সবজি চাষ করলেও এবার শখের বসে প্রথম সৌদি আরবের সামমাম চাষ করি। কোন প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই এই সামমাম চাষে এতটা সফলতা পাবো চিন্তা করিনি। তিনি বলেন, চাষাবাদে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। এই পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকার ফসল বিক্রি করেছি। এখনো যা আছো তা আরো ৫০/৬০ হাজার টাকা বিক্রি হবে।

একই গ্রামের তোফেজ্জেল হোসেন বলেন, আনন্দনগর বিলে ৬বিঘা জমিতে বাঙ্গী, কুমড়া, শসা, গ্রীষ্মকালীন টমোটো ও অফসিজনের তরমুজের চাষ করেছি। চাষাবাদে খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে শুধু শসা বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ হাজার টাকার। অন্যান্য ফসল লাখ টাকায় বিক্রি হবে। তিনি বলেন, আমাদের এই বিলের কোথাও ফাঁকা নেই। প্রতিটি ঘেরের বেড়িতে বলতে গেলে ১২ মাস বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ হয়ে থাকে। এতে মৎস্য চাষিরা বাড়তি আয় করছে। আমাদের এই চাষাবাদে যেকোন সমস্যা হলে কৃষি অফিস পরামর্শ দিয়ে থাকে। বাড়তি লাভের কারণে দিন দিন ঘেরের বেড়িতে চাষাবাদ বাড়ছে।

পাথরঘাটা গ্রামের চাষী খাজা মহিউদ্দীন বলেন, পদ্ম বিলে দুটি ঘেরের বেড়িতে টমেটো, লাউ, মরিচ ও লেবু চাষ করেছি। এর একটি ঘের ১০০ শতক ও অপরটি ৩৩ শতক। ফলন খুব ভালো হয়েছে। চাষাবাদে ব্যয় হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। আশা করি লক্ষাধিক টাকার ফসল বিক্রি হবে।

তিনি বলেন, যেকোন ফসলের মৌসুম আসলে উপজেলা কৃষি অফিসের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস আমাদের চাষীদের নিয়ে মিটিং করে কার কি সমস্যা শুনে সঠিক পরামর্শ দেন। এছাড়া চাষাবাদের ব্যাপারে মৌসুমী চাষীদের কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় বিনামূল্যে সারবীজ দেওয়া হয়। এগুলি আমরা নিজেরা আলোচনা করে যার বেশি অসুবিধা তাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

ওই চাষি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের এই পদ্মবিলে ১৫শ’ একর জমির একটুও ফাকাঁ নেই। উপজেলার সামন্তসেনা, তিলক, পাথরঘাটা, দেবীপুর, খাজাডাঙ্গা, আমদাবাদ, ইলাইপুর, বাঐডাঙ্গাসহ ১০/১২ টা গ্রামের কয়েক হাজার চাষীর জীবিকা এই বিলে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সরকারের কাছ থেকে এই বিলের খাল লিজ এনে বর্ষা মৌসুমে রাতের জোয়ারে তলিয়ে দিয়ে অন্যান্য ঘেরের মাছ টেনে নিয়ে যায়। এতে চাষীরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়। তিনি এই বিলের খাল যাতে লিজ না দেওয় হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান।

শুধু পদ্ম বিল বা আনন্দরগর বিল নয়, এ মৌসুমে উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নে ১৩ হাজার ৪৭৫ বিঘা, শ্রীফলতলা ইউনিয়নে ২২হাজার ৫০০ বিঘা, নৈহাটী ইউনিয়নে ২২হাজার ৫০০ বিঘা, টিএসবি ইউনিয়নে ৮৬ হাজার ২৫০ বিঘা ও ঘাটভোগ ইউনিয়নে একলাখ ৫৯ হাজার বিঘা জমিতে উচ্ছে, করোলা, চাল কুমড়া, ঝিঙ্গা, ধুন্দল, মরিচ, চিচিঙ্গা, ঢ্যাডস, পুঁইশাক, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শসা, কলা পেঁপে ও বরবটি চাষ হচ্ছে।

উপজেলার টিএসবি ইউনিয়নের তিলক ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিমাদ্রী বিশ্বাস বলেন, চাষীদের যে কোন সমস্যা হলে আমরা সাথে সাথে সঠিক পরামর্শ দিয়ে থাকি। যে কারণে ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ দিন দিন বাড়ছে। তার মতে এ উপজেলার ঘেরের পাড়গুলি যেন চাষিদের এক সবুজ বিপ্লবের ফল।

ঘাটভোগ ব্লকের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সোহেল রানা বলেন, আমার ব্লকের আনন্দনগর বিলে এবছর সৌদী আরবের সামমাম (রকমিলন) চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চাষী জাহাঙ্গীর হোসেন। তার সফলতা দেখে অন্যান্য চাষী আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, চাষিরা কখন কী কী চাষ করছে, কার কী সমস্যা এগুলি নিয়মিত মনিটরিং করি। কারো কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তরুণ কুমার বালা বলেন, চলতি মৌসুমে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মাছের ঘেরের পাড়ের ৪০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে ফল ও শাক সবজি চাষে সবুজ বিপ্লব ঘটেছে। একজন চাষী যখন চাষাবাদে সফলতা অর্জন করেন তখন আমাদেরও ভালো লাগে। এ উপজেলার কোন চাষীকে কৃষি বিষয়ক পরমর্শ নেওয়ার জন্য কৃষি অফিসে আসতে হয়না। অফিসে ফোন করলে তার জমিতে সেবা পৌঁছে দিচ্ছি। তাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য ২৪ ঘন্টা আমার মোবাইল খোলা থাকে।

তিনি বলেন, সরকারিভাবে যখন যে প্রণোদনা বা সার-বীজ আসে তা আমার প্রকৃত চাষির হাতে তুলে দিচ্ছি। এতে চাষীরা খুব খুশি।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন