মনোয়ারা বেগম (৬৬) একটি ঠিকানা আছে-সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর বউ বাজার বস্তি। কিন্তু রাষ্ট্রের খাতায় তার কোনো পরিচয় নেই। ১৫ বছর আগে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে খোলপেটুয়া এবং কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে ঘরবাড়ি, জমিসব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে তিনি এই শহরে এসেছিলেন। সেই থেকে তিনি শহরের ভোটার নন, আর গ্রামের ঠিকানাও বিলীন। ফলস্বরূপ, বয়স্ক এবং বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেও তিনি বারবার প্রত্যাক্ষিত।
মনোয়ারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “২০০২ সালে আমার স্বামী মারা যায়। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তিন মেয়েকে নিয়ে কোন রকম চলতো। ২০০৯ সালে আইলার সময় বাড়ি ঘর বিলীন হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সাতক্ষীরা শহরে চলে আসি। অনেক কষ্টে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সাতক্ষীরা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কামলানগর বউ বাজারে ছোট একটি তরকারির দোকান আছে। সেখানে যে টাকা বেচা বিক্রি হয়ে, সেটা দিয়ে কোন রকম ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকি। গাবুরা ইউনিয়নে ভোটার কিন্তু শহরে থাকি। আমরা শহরের কেউ না। সরকার আমাদের দেখেও দেখে না।” বিধবা ভাতার জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে ঘুরছেন তিনি।
মনোয়ারা বেগম একা নন। সাতক্ষীরা শহরের মেহেদীবাগ, কামালনগর, সুলতানপুর, বাঁকাল ইসলামপুর কলোনী, রাজার বাগান, গদাইবিল, মাঠপাঠা, বদ্যিপুর কলোনী, গড়েরকান্দা, বকচরাসহ বিভিন্ন নিচু এলাকায় গড়ে ওঠা ৪৭ টি বস্তিগুলোতে বাস করছেন এমন হাজারো জলবায়ু উদ্বাস্ত, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে গ্রামে সর্বনাশা নদীভাঙন আর লবণাক্ততার ছোবলে সহায়-সম্বল হারিয়ে যারা সাতক্ষীরা শহরে একটু আশ্রয়ের আশায় এসেছেন, তারাই এখন শহরের বুকে ‘পরিচয়হীন’। তারা শহরের বাসিন্দা, কিন্তু নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত-রাষ্ট্রের খাতায় তারা যেন অদৃশ্য। স্থায়ী ঠিকানা আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা কিংবা ভিজিএফ কার্ডের মতো ন্যুনতম সামাজিক সুরক্ষা থেকে।
সাতক্ষীরা পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ৩১.১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পৌরসভায় দুই লক্ষের বেশি মানুষের বসবাস। এখানে মোট ৪৭টি বস্তি আছে। এর মধ্যে ১৫টি সরকারি ও কিছু গুচ্ছ বস্তি রয়েছে। সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় ৩৪ হাজার খানা রয়েছে। এর মধ্যে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এর সিংহ ভাগ বিভিন্ন সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজ নিজ এলাকা থেকে তাড়িত হয়ে এখানে সরকারি অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে বসতি গড়েছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে সাতক্ষীরা পৌরসভার সুলতানপুর, আতির আমবাগান বস্তি, মধুমালাডাঙি, গুটিরডাঙ্গি, কামালনগর, ইটাগাছা, রাজারবাগান, বাঁকাল ইসলামপুর, এল্লারচরসহ বিভিন্ন বস্তি ঘুরে দেখা গেছে, এমন শত শত পরিবার, যাদের শেকড় শ্যামনগর, আশাশুনি বা কয়রার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে। জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম আঘাতে ভিটেমাটি হারিয়ে তারা শহরে এসেছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে এখনও রয়ে গেছে বিলীন হয়ে যাওয়া গ্রামের ঠিকানা। শহরের বাসিন্দা হিসেবে কোনো হোল্ডিং নম্বর বা স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র না থাকায় তারা সরকারি তালিকার জন্য বিবেচিত হচ্ছেন না।
সাতক্ষীরা পৌরসভায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রতিক বেসরকারি সংস্থা উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পৌরসভায় মোট ১০ হাজার ১৩৩টি পরিবার বিভিন্ন স্থান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে। এর মধ্যে সিংহভাগই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ শিকার। মোট বাস্তুচ্যুত পরিবারের মধ্যে ৮ হাজার ৫০১ টি পরিবারের ৩৬ হাজার মানুষ পরিবেশগত কারণে, যেমন-ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততার কারণে তাদের ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারিয়ে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এটি মোট বাস্তুচ্যুত পরিবারের প্রায় ৮৪ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ¯্রােত সবচেয়ে বেশি আশ্রয় নিয়েছে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে।
পরিচয় সংকটের আমলাতান্ত্রিক জাল : জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বঞ্চনার মূলে রয়েছে পরিচয়হীনতা। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে গ্রামের যে ঠিকানা উল্লেখ আছে, তার অস্তিত্ব এখন আর নেই। শহরে নতুন করে ভোটার হতে বা ঠিকানা পরিবর্তন করতে প্রয়োজন হয় হোল্ডিং নম্বর অথবা বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র, যা বস্তিতে বসবাসকারী এই মানুষদের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব।
শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়ন থেকে ইয়াসিন গাজী (৫৬) নদী ভাঙনের ফলে সাতক্ষীরা শহরের গড়ের কান্দা বস্তিতে ঠাই হয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের জন্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আগে ভোটার হয়ে আসতে বললেন। তবে ভোটার হবো কীভাবে? আমাদের তো কোনো পাকা ঘর নেই, হোল্ডিং নম্বরও নেই। এই কাগজ ওই কাগজ চাইতে চাইতে বছর পার হয়ে যায়, কিন্তু কাজ হয় না। নির্বাচন অফিসে একাধিকার গিয়েছি। তারা টাকা চেয়েছে, সেজন্য আর ভোটার হতে পারিনি।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : সাতক্ষীরা পৌরসভার সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, “আইপিসিসির তথ্যমতে, ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলের ১৭ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্ত হবে। ইতোমধ্যেই এর প্রভাব স্পষ্ট। একই সাথে ৪০ শতাংশ জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। দলে দলে মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে শহরের বস্তিতে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত অসহায় দরিদ্র পীড়িত এসব মানুষ পৌরসভার নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। একই সাথে তারা পৌর এলাকায় বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। সঠিক তথ্য না থাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া পৌরসভার জন্য কষ্টসাধ্য। পৌরসভায় ও একটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে একটি ডাটাবেজ তৈরী করেছি। বস্তিবাসীর উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করছি। ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে ভ্যান, সেলাই মেশিনসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ছাগল পালনের জন্য খামারও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এএজে