খুলনা, বাংলাদেশ | ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৩০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  একদিনে রেকর্ড ৪২৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি
  আবু সাঈদ হত্যা মামলায় পলাতক ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
  খুলনা সাতক্ষীরা মহাসড়কের হোগলাডাঙ্গায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই জন নিহত

কী ঘটেছিল মুরাদনগরে

গেজেট ডেস্ক

কুমিল্লার মুরাদনগরের পাঁচকিত্তা গ্রাম। ১৮শ’ মানুষের এই গ্রামটিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আলোচনা সারা দেশে। ২৬শে জুনের ধর্ষণের ঘটনাটি প্রকাশ পায় শনিবার রাতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয় দেশ জুড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে তৎপর হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কেন কীভাবে এই ঘটনাটি ঘটেছে তার সরজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। ঘটনাটি ঘিরে পাওয়া গেছে নানা রহস্য ঘেরা তথ্য।

ধর্ষণের অভিযুক্ত ফজর আলী ভুক্তভোগী পরিবারের পূর্বপরিচিত। তাদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন আছে বলে এলাকার লোকজন জানেন। ফজরের ভাই শাহ পরানের সঙ্গে আগে পরিবারটির যোগাযোগ ছিল। তার সঙ্গেও আর্থিক লেনদেন ছিল। শাহ পরানের সূত্র ধরেই ফজর আলী ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঘটনার দিন ফজর আলীকে ধরে মারধর ও ওই নারীর বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনেও ফজর আলীর ভাই শাহ পরানের হাত রয়েছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে ফজর আলীর পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে এমন আলোচনাও আছে এলাকায়। তবে ভুক্তভোগী পরিবার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে আর্থিক লেনদেনের কারণেই ফজর আলীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল। এর বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।

সূত্র মতে, গত ২৬শে জুন রাতে ফজর আলী ওই নারীর বাড়িতে যান। ৫০ হাজার টাকা পাওনা আদায়ের উদ্দেশ্যে তিনি সে বাড়িতে যান। এ সময় বাড়িতে ভুক্তভোগী নারীর বাবা-মা কেউ ছিলেন না। ভুক্তভোগী নারীর দাবি, এ সময় ফজর আলী ঘরের দরজার খিলি ভেঙে প্রবেশ করে তাকে ধর্ষণ করে।

এদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্র বলছে, ঘটনার সময় আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে ভুক্তভোগী নারীকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে জোরপূর্বক তার ভিডিও ধারণ করে এবং পরে শনিবার রাতে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এ সময় মারধরের শিকার হয়ে ফজর আলী পালিয়ে যায়। পরদিন শুক্রবার ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে মুরাদনগর থানায় মামলা করেন।

ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামী গত পাঁচ বছর ধরে প্রবাসে রয়েছেন এবং তার দুটি সন্তান রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যেই ফজর আলী পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তবে তাদের পৈতৃক বাড়ি ঘটনাস্থলের ঠিক উল্টো পাশেই। এই বাড়িতে ফজর আলীর বোন ও অন্য ভাই থাকেন।

ওই নারীকে নির্যাতনের ৫১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও শনিবার রাত থেকে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় বিবস্ত্র অবস্থায় ৮/১০ জন যুবক ওই নারীকে মারধর করছে। এ সময় ওই নারী বাঁচার জন্য চিৎকার করলেও কেউ তাকে রক্ষা করেনি।

স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বলেন, ফজর আলীর ভাই শাহ পরানের সঙ্গে ওই নারীর সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন ধরে তাদের সম্পর্ক চলছিল। এই সম্পর্ক এক সময় ফজরের সঙ্গে গড়ে ওঠে। তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ফজর ওই বাড়িতে যাওয়ার খবরে শাহ পরান দলবল নিয়ে হাজির হয়। এ সময় দু’জনকে খালি গায়ে পেয়ে নির্যাতন শুরু করে। ওই মেয়েটির ভিডিও করে। আর ফজর আলীকে ব্যাপক মারধর করে।

ভুক্তভোগী নারী বলেন, তার বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ফজরের টাকা-পয়সা নিয়ে ঝামেলা আছে। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে ফজর বাড়িতে গিয়ে ঘরের দরজা খুলতে বলেন। তিনি খুলতে না চাইলে ফজর টিনের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন।

ভুক্তভোগীর ভাই বলেন, ঘটনার সময় বাড়িতে তাদের মা-বাবা ছিলেন না। তারা সাপ্তাহিক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তিনি নিজে পাশের উপজেলা তিতাসে ছিলেন। সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বাড়িতে তার বোন, বোনের ছোট দুই ছেলেমেয়ে ছিল। তারা ঘুমিয়ে ছিল।

বোনের বিবস্ত্র অবস্থার ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া প্রসঙ্গে ওই নারীর ভাইয়ের ভাষ্য, শাহ পরানের সঙ্গে ফজর আলীর বিরোধ আছে। সেই বিরোধের জের ধরে শাহ পরানই ঘটনার সময় তাদের বাড়িতে লোকজন পাঠান। তারাই তার বোনকে বিবস্ত্র অবস্থায় মারধর করে সেই ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

এদিকে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত ফজর আলীর বোন রাবেয়া বলেন, ফজর আলী টাকা-পয়সার লেনদেন করতো ওই মেয়েটার সঙ্গে। ওইদিন রাতে টাকা পাবে বলে তাদের ঘরে যায়। এরপর ওই মেয়েটা আরেক গ্রুপকে দিয়ে ফজরকে মারধর করায়। ফজরের দুই পা দুইটা হাত ভেঙে দিয়েছে। অনেকে বলছে মেয়েটার সঙ্গে ফজরের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এটা মিথ্যা।

নারীর বিবস্ত্র ভিডিও ভাইরাল কাণ্ডে নেতৃত্ব দেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা সুমন

প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার ‘প্রতিবাদ’ করার নামে উল্টো একই এলাকার ৮/১০ জন যুবক দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ওই নারী ও পুরুষকে মারধর করেন। পরে নারীর বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরো ঘটনার নেতৃৃত্ব দেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা সুমন। তিনি রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বাহেরচর গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে। এ ঘটনায় পুলিশ রোববার ভোর পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা হচ্ছেন ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার একমাত্র আসামি ফজর আলী এবং ভিডিও ধারণ ও নারীকে মারধরে জড়িত একই এলাকার আবদুল হান্নানের ছেলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা সুমন, জাফর আলীর ছেলে রমজান, মো. আলমের ছেলে মো. আরিফ ও তালেম হোসেনের ছেলে মো. অনিক। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান ৫ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, ওই নারী গ্রেপ্তার ফজর আলীর পূর্ব পরিচিত। বৃহস্পতিবার রাতে ফজর আলী ওই বাড়ির দিকে রওনা করলে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সুমনের নেতৃত্বে তার আরও ৭/৮ জন সহযোগী তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য ফাঁদ পাতে। এ সময় ফজর আলী ওই নারীর ঘরে প্রবেশ করলে ছাত্রলীগ সভাপতি সুমনসহ তার সঙ্গীরা ঘরে ঢুকে তাদের হাতেনাতে আটক করে। প্রথমে ফজর আলীকে বেধড়ক পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেয়া হয়। এ সময় ওই নারীর বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে পরিকল্পিতভাবে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

স্থানীয় বাহেরচর এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ছাত্রলীগ নেতা সুমনের নেতৃত্বে একদল বখাটে দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় নানা অপকর্ম করে আসছে। তারা রাতের অন্ধকারে গ্রামের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে শুধু এসব খুঁজে বেড়ায়। কার ঘরে কে প্রবেশ করছে এসব ধরার জন্যই তারা ফাঁদ পেতে থাকে।

মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজনের মধ্যে মো. সুমন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। সুমনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। আমরা গ্রেপ্তারকৃতদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছি। ঘটনার নেপথ্যের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয়রা দাবি করছে বিষয়টি পরকীয়া। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আরও অনেক তদন্ত করা দরকার। তদন্তের পরই বিস্তারিত বলা যাবে।’

এদিকে রোববার সরজমিন গিয়ে দেখা ওই বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পিবিআই, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। স্থানীয় উৎসুক জনতাও বাড়িতে ভিড় করছে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় ওই নারীর সকল নিরাপত্তার দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, ঘটনার প্রধান আসামি (ধর্ষক) ফজর আলীসহ ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ফজর আলী ছাড়া অপর ৪ জনের বিরুদ্ধে ভিকটিম বাদী হয়ে নারী নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত থাকলে তাদেরকেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।

ধর্ষকের দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি সনাতনীদের

এদিকে নারীকে বিবস্ত্র করে জোরপূর্বক ভিডিওতে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। নগরীর রাণীর বাজার রামঠাকুরের আশ্রম থেকে সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চার আয়োজনে এ প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবাদ মিছিলটি রাণীর বাজার থেকে বের হয়ে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হয়। ওই প্রতিবাদ মিছিলে বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি চন্দন কুমার রায়। বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তাপস কুমার বকসী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট বিকাশ সাহা ও কমল চন্দ খোকন প্রমুখ।

অপপ্রচারের প্রতিবাদ বিএনপি’র

ওদিকে মুরাদনগরে হিন্দু নারী ধর্ষণের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকে বিএনপি বলে অপপ্রচারের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছেন উপজেলা বিএনপি’র নেতাকর্মীরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া। গতকাল কুমিল্লা নগরীর বধূয়া কমিউনিটি সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন তারা। এ সময় তারা ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আহ্বান জানান। বিএনপি’র বিরুদ্ধে যারা অপপ্রচার চালিয়ে, সারা দেশে বিএনপি’র মানক্ষুণ্ন করেছেন তাদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!