খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৩ জনের করোনা পজিটিভ
  খুলনায় যুবদল নেতাকে গুলি করে ও পায়ের রগ কেটে হত্যা

বর্ষাকাল

মো: আরাফাত হোসেন

মাসটা আষাঢ়। আকাশে মেঘের গর্জন। এই মুহূর্তে আকাশটা যেন ভেঙে পড়বে জমিনের বুকে। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কখনও তা মুষলধারেও ঝরছে। রাসেলের মনটা আজ ভালো না। তার মা তাকে বৃষ্টি মাথায় খেলতে যেতে নিষেধ করেছে। অথচ তার বন্ধুরা সব মাঠে ফুটবল খেলছে, সে কি করে ঘরে বসে থাকে! মুখ গোমড়া করে জানলার পাশে বসে সে বৃষ্টি পড়া দেখছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। এই বৃষ্টি পেয়ে মাটি যেন প্রশান্ত হয়েছে। গাছপালাগুলো নতুন করে বাঁচার তাগিদ পেয়েছে। গাছগুলোর তৃষ্ণার্ত হৃদয় যেন ঠান্ডা হয়েছে এই বৃষ্টিতে।

রাসেলের মন খারাপ কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার মা এই বৃষ্টির মাঝে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি এনে ধরলো রাসেলের সামনে। সাথে সাথে তার মনটা ভালো হয়ে গেলো। এমনিতেই খিচুড়ি রাসেলের পছন্দের তার উপর আবার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। দুইয়ে মিলে বিষয়টা জমে উঠেছে। টিনের চালের উপর বৃষ্টি পড়ার ঝম ঝম শব্দ সাথে গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম এক অন্য রকম ভালো লাগার মুহূর্ত তৈরি করে দিয়েছে তার কাছে।

রাসেলের মন ভালো হয়ে গেলেও রাসেলের পিতা রহিম মিয়া কিন্তু বেশ চিন্তিত। বর্ষার আগমনের সাথে সাথেই রহিম মিয়ার মতো চাষিদের কাজের আর বিরাম থাকে না। বর্ষাকালের এই ঝুম ঝুম বৃষ্টি যে প্রভুর কাছ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ আসে সে সম্পর্কে রহিম মিয়ার বিশ্বাস অটল। কিন্তু তার দুশ্চিন্তার বিষয় অন্য জায়গায়। বর্ষাকালে এই বৃষ্টি জমলে জমি চাষ করে ধান রোপন করতে হবে। ধান রোপণের জন্য সার কেনা চাই, ধানের চারা কেনা চাই, লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা চাই অনেক খরচ। আর খাটুনির কথা তো আছেই। এদিকে রহিম মিয়ার হাতের অবস্থা ভালো নয়, ইদানীং সে আর্থিক টানাপোড়েনে আছে। ধার দেনা করে চলতে হচ্ছে। তাই বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ দেখা যাচ্ছে।

একসময় সকল দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে রহিম মিয়া বেরিয়ে পড়ে মাঠের উদ্দেশ্যে। বৃষ্টিতে ভিজে কৃষিকাজ করা এই বাংলার কৃষকদের নিত্যদিনের ঘটনা এটা নতুন কোনো বিষয় না। রহিম মিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এখন তার প্রথম কাজ ধান রোপনের জন্য জমি প্রস্তুত করা। কোদাল নিয়ে সে রওনা হয় মাঠের উদ্দেশ্যে। প্রতিমধ্যে আক্কাস মিয়ার সাথে দেখা।

আক্কাস মিয়া জিগ্যেস করে, “কি গো রহিম মিয়া কনে যাচ্ছাও বৃষ্টি মাথায়?”

রহিম বলে, ” এইতো এট্টু মাটের দিক যাতি, দেকি নাঙল পাই কিনা, জমিডা চাষ দে নোবো। ধান লাগাতি হবে যে।”

আক্কাস মিয়া বলে, ” তা ভালো, ভালো, তা তুমি পানির মধ্যি ভিজতি ভিজতি যেতিছাও কেন? মাতায় কিছু দে যাও।”

রহিম বলে, ” আমাগির জন্যি তো এ পানি নতুন না, বাপ-দাদার সাতে এরাম ভিজতি ভিজতিই তো কাজ কুরা শিখিছ, এখন আর পানিতি ভিজলি কিছু হয় না। তা যায় আক্কাস ভাই।”

আক্কাস মিয়া, ” ঠিক আছ যাও যাও, আমিও দেখি পূবীর মাটের জমিডা চষপো, নাঙল পাই কিনা দেকি আসি।”

রহিম মিয়া মাঠে গিয়ে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ দেয়, চাষ দেওয়া শেষ হলে কোদাল দিয়ে আইলগুলো কেটে ছেঁটে বাড়িতে ফিরে আসে।

কাছে টাকা নেই। ধানের চারা কেনা প্রয়োজন, সার কেনা প্রয়োজন। এখন একটাই উপায় ধার করে চারা, সার কিনতে হবে। তাই মহরম ডিলারের কাছ থেকে বকেয়া সার আর ধানের চারা সে নিয়ে আসে।

রহিম মিয়া বলে, “মহরম ভাই, আমার এট্টু সার আর ধানের চারা দরকার। কিন্তু এখন টাকা দিতি পারতি নি, এট্টু বাকিতে দুবা?”

মহরম ডিলার বলে, ” দিতি পারি তবে শর্ত হচ্ছি গে, ধান উঠার সাতে সাতে বাকি মিটাই দিতি হবে।”

কোনো উপায় না দেখতে পেয়ে রহিম মিয়া রাজি হয়ে যায়। এই মহরম ডিলারের সম্পর্কে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। সে নাকি বকেয়া সার, ধানের চারা দিয়ে দ্বিগুণ টাকা ধার্য করে কৃষকদের কাছে। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই রহিম মিয়ার।

বাইরে বৃষ্টির কিন্তু কোনো কমতি নেই। আজ দিয়ে তিন দিন টানা বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে তো কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। রহিম মিয়া তার স্বপ্নগুলো মাঠে রোপন করে আসে ঠিকই কিন্তু এই স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা সে জানে না। ধানের চারাগুলো নতুন পানি পাওয়ায় রোপনের সাথে সাথে যেন সজীবতা ফিরে পায়। সে এক নতুন জীবন।

একদিন সেই সময় আসবে, যখন ফসল কাটার মৌসুম উপস্থিত হবে। একটা অংশ বিক্রি করে ধার দেনা পরিশোধ করা হবে। আর একটা অংশে সারাবছরের খাওয়া পরার বন্দোবস্ত। হয়তো সেই দিন আসবে নয়তো না। কিন্তু রহিম মিয়ার জীবনে সজীবতা ফিরে আসে ওই ধানের চারা রোপনের মাঝেই।

রহিম মিয়াদের বাঁচার তাগিদ নিয়ে, জীবনের সজীবতা ফিরিয়ে দিতে প্রতি বছর হয়তো বর্ষাকালের আগমন ঘটে। এই বর্ষাকাল আশীর্বাদরূপে বর্ষিত হোক রহিম মিয়াদের আঙিনাতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!