কার্যাদেশ অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর খুলনাবাসীর বহু প্রতীক্ষিত এবং প্রত্যাশিত ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিলো। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। মেয়াদ বাড়ানোর পরও গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৩৭ মাসে সেতুর নির্মাণ কাজের মোট অগ্রগতি ছিল মাত্র সাড়ে ১৪ শতাংশ। কাজের এই ধীরগতির কারণে তৃতীয় দফায় দুই বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে অর্থাৎ ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। কাজের এই অগ্রগতিতে হতাশ খুলনাবাসী।
এদিকে সম্প্রতি সেতুর শহরাংশে ১ নং পিলারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
খুলনা সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) সূত্রে জানা যায়, নদীর উপর ১০০ মিটারের পরিবর্তে ১৬০ মিটার কংক্রিট সেতু নির্মাণ হবে এ পর্যন্ত ভৈরব সেতু প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেতুর আর্থিক অগ্রগতি ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এটিকে সেতুর প্রশস্ততা বাড়ায় ১৭,১৮ ও ১৯ নং পিলারের নকশায়ও সংশোধন আনতে হবে। প্রকল্পের দৌলতপুর মুহসিন মোড়ের আগে হতে এপ্রোচ সড়কে একটি আন্ডারপাস নির্মাণ, সেতু নির্মাণের জন্য ভেঙ্গে ফেলা দুইটি মসজিদ ও একটি ঈদগাহ নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। এজন্য প্রকল্পটি সংশোধন করতে হবে।
সওজ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি সংশোধিত কিংবা প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন আনা হলেও প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে না। জমি অধিগ্রহণের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়েই সংশোধিত প্রকল্পের ব্যয় মেটানো হবে। বর্তমান প্রকল্পের ব্যয় ৬১৭ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
বর্তমান নকশায় নদীর উপর ১০০ মিটার কংক্রিট সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল। আর সেতুর প্রশস্ততা হওয়ার কথা ছিল ৭ দশমিক ৩ মিটার বা প্রায় ২২ ফুট। স্বল্পগতির যানবাহন এবং সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য পৃথক কোন লেন ছিল না। এতে করে ভবিষ্যতে যানবাহনের চাপ বাড়লে যানজট এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখা দেবে এ সকল বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেতুর ডিজাইনে পরিবর্তন আনায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
সংশোধিত নকশায় ১০০ মিটারের পরিবর্তে ১৬০ মিটার কংক্রিটের সেতু এবং ৭ দশমিক ৩ মিটারের পরিবর্তে ১০ দশমিক ২ মিটার প্রশস্ত করার প্রস্তাবনা হয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবনায় সেতুর প্রশস্ততা বাড়ানোর হলে সেতুটি দিয়ে পাশাপাশি দুটি গাড়ি ক্রস করে যেতে পারবে। অর্থাৎ এখন সেতুটি হবে দুই লেনের।
সোমবার (৮ জুলাই) প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেতুর শহরাংশে রেলিগেট সংলগ্ন খুলনা যশোর মহাসড়কের পূর্ব পাশে ১ নং পিলারের পাইলিংয়ের কাজ চলছে জোরেসোরে। তদারকির কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) ‘র সাইড ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আজিজুল হাসান আকাশ জানান, এ পিলারটির ১০ টা পাইলের মধ্যে ইতিমধ্যে ৭ টা পাইল সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে বাকী ৩ টির পাইলিং সম্পন্ন হবে। এরপর পিলারটির ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজের প্রস্তুতি শুরু করা হবে।
এ প্রান্তে সেতুর ভৈরব নদী সংলগ্ন তিনটি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে। এছাড়া সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে ১৭ থেকে ২৮ নং মোট ১২ টি পিলার দৃশ্যমান হয়েছে।
সেতুর প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী এস এম নাজমুল খুলনা গেজেটকে বলেন , জমি বুঝে পাওয়ায় সম্প্রতি সেতুর শহরাংশে ১ নং পিয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে বাকী পিয়ার (পিলারের) নির্মাণ কাজগুলো শুরু করবো। সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে ১৭,১৮,১৯ নং পিলারের পাইলিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পিলার তিনটি’র পাইল ক্যাপের জন্য প্রস্তুতি চলছে। ২০ থেকে ২৪ নং পিলারের কলাম ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২১ থেকে ২৫ নং পিলারের পিয়ার ক্যাপ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০ এবং ২৬ থেকে ২৮ নং পিলারের পিয়ার ক্যাপ ঢালাইয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, সময়মতো জায়গা বুঝে না পাওয়ার কারণে সেতুর নির্মাণ কাজের ধীরগতি দেখা দেয়।
এদিকে সরজমিনে সেতুর শহরাংশের নির্মাণ কাজের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এ অংশে অধিগ্রহণকৃত জমির উপর থেকে স্থাপনা অপসারণের কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে। এ অংশে রেলের জায়গার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। কবে নাগাদ হবে এরও কোন সন্তোষজনক জবাব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ফলে দুই বছর সময় বৃদ্ধি পেলেও ২০২৬ সালের ৩০ শে জুনের মধ্যে ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভৈরব সেতু নামে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। এরপর ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সওজ ‘র খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ভৈরব নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেতুর নির্মাণকাজ দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ১৩ দিন পর ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই উক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার ৬ মাস পর ২০২১ সালের ২৪ মে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে সরকারি খাস জমির উপর ২৪ নং পিলারের টেস্ট পাইলিংয়ের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে ভৈরব সেতুর নির্মাণ কর্মযজ্ঞ।
ভৈরব সেতুর পিলার বসবে মোট ২৮ টি। এর মাধ্যে সেতুর শহরাংশে কুলিবাগান হতে রেলিগেট ভৈরব নদীর তীর পর্যন্ত ১ থেকে ১৪ নং পিলার এবং সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে ১৭ থেকে ২৮ নং পিলার বসবে। সেতুর রেলিগেট প্রান্তে নদীর পাড় থেকে ৪২ মিটার ভেতরে ১৫ নং এবং সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে নদী পাড় হতে ১৮ মিটার ভেতরে ১৬ নং পিলার বসবে। এই দুই পিলারের উপর ১৬০ মিটার স্টিলের সেতু বসবে। ভৈরব সেতু নির্মাণ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। এরমধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। বাকী টাকা সেতু সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে ব্যয় হবে।