সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালে আজ বুধবার (২০ মার্চ) থেকে সপ্তাহে দুই দিনের পরিবর্তে একদিন কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস করা হবে। হঠাৎ করে সপ্তাহে একদিন ডায়ালাইসিস করার ঘোষণা দেওয়ায় মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়েছে জেলার শতাধিক কিডনি রোগী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিডনি রোগীদের জন্য ডায়ালাইসিস সেবা চালু হওয়ার পর থেকে একজন রোগীকে সপ্তাহে দুইবার অথবা তিনবার ডায়ালাইসিস সেবা প্রদান করা হতো। এর জন্য নামমাত্র ২০০ টাকা ফি নেওয়া হতো। সেসময় জেলার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কিডনি রোগীরা সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতেন ডায়ালাইসিস করার জন্য। প্রায় বছরখানেক আগে হঠাৎ করে রিএজেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় রোগীদেরকে বাইরে থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে রিএজেন্ট কিনে আনতে হতো। তখন হাসপাতালের মোট ১৯টি ডায়ালাইসিস মেশিনের সবগুলো চালু ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে আস্তে আস্তে একটি একটি করে মেশিন নষ্ট হতে থাকে। ফলে ক্রমশঃ চাপ বাড়তে থাকে বাকি মেশিনগুলোর উপর। নষ্ট মেশিনগুলো সময়মত মেরামত না করায় বর্তমানে হাসপাতালে মাত্র তিনটি মেশিন চালু আছে। যা দিয়ে তালিকাভুক্ত প্রায় শতাধিক কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফোন করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বুধবার (২০ মার্চ) থেকে সপ্তাহে দু’টির পরিবর্তে মাত্র একটি ডায়ালাইসিস করানো হবে। ফলে ডায়ালাইসিস সেবা সপ্তাহে একবারের ঘোষণা দেওয়ায় মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছেন শতশত কিডনি রোগী।
সাংবাদিক জহুরুল কবীর জানান, তিনি জমিজমা সহায়-সম্পদ বিক্রি করে কিডনি আক্রান্ত স্ত্রীকে চিকিৎসা করিয়ে আসছিলেন। ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সক্ষমতা তার নেই। ফলে কম খরচে সামেক হাসপাতাল থেকে ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণ করে স্ত্রীকে কোন রকমে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এমতাবস্থায় হাসপাতাল থেকে মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে বুধবার থেকে সপ্তাহে একবার কিডনি আক্রান্ত রোগিদের ডায়ালাসিস করানো হবে। খবরটি শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। এ যেন জীবন মৃত্যুর খবর। স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য তিনি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতালে কিডনি রোগিদের জন্য ডায়ালিসিস সেবা চালু রাখতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে সাধারণ রোগিরা জানান, শতাধিক রোগীর জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বন্ধপ্রায় সামেক হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট। মঙ্গলবার ডায়ালাইসিস ইউনিট ইনচার্জ নমিতা রানী রোগীদের ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন বুধবার থেকে সপ্তাহে দু’টির পরিবর্তে একটি ডায়ালাইসিস করানো হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, ১৯টি মেশিনের মধ্যে মাত্র দু’টি জোড়াতালি দিয়ে চলছে। তাই সপ্তাহে আর দুই অথবা তিনবার ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে না। এটি পরিচালকের সিদ্ধান্ত।
রোগীদের অভিযোগ, পরিচালককে দীর্ঘ দেড় থেকে দুই বছর যাবৎ মেশিন মেরামতের কথা বলে আসলেও তিনি ‘চেষ্টা করছি’ বলে তার রুম থেকে বের করে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদর উপজেলার ফিংড়ির একজন রোগী জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যখন মাত্র চারটা মেশিন চালু ছিলো তখন আমরা ক’জন রোগী নিয়ে পরিচালকের নিকট গেলে তিনি আমাদের ধমক দিয়ে বলেন, এখানে ঝামেলা করেন না, বাইরে যান। এরপর আমাদেরকে তার রুম থেকে বের করে দেন।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পর তিনি খুলনায় আবু নাসের হাসপাতালে যান। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার নরমাল স্যালাইন শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের সপ্তাহে একটি করে ডায়ালাইজার ও একটি করে ব্লাডলাইন রিফিলকৃত (ওয়াশকৃত) নিতে হয়। এছাড়া রক্তের ইনজেকশন ইপোটিন (ইথ্রোপোয়েটিন), বি-ক্যান ফ্লুইট, সিরিঞ্জ ইত্যাদি কিনতে হয়। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ডায়ালাইসিস ইউনিট ইনচার্জ নমিতা রানী ফোন করে জানান, বুধবার থেকে সপ্তাহে একটি করে ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে। এখন মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।
শ্যামনগর উপজেলার বংশিপুরের আজিজ মোড়লের ছেলে কিডনি রোগী জয়নাল (৩০) জানান, আমার মা গ্রামে গ্রামে ও হাট-বাজারে ভিক্ষে করে আমার ডায়ালাইসিস খরচ চালায়। এখন যদি এখানে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয় তাহলে যেকোন সময় আমার মৃত্যু হবে। কারণ প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস করানোর সামর্থ্য আমার নেই।
অপর একজন রোগী নলতার ময়নুদ্দিনের ছেলে মহিউদ্দীন (৩০) জানান, বুধবার আমার ডায়ালাইসিসের দিন কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেছে আগামী রোববার আসতে। আর এবার থেকে সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস দেওয়া হবে। এখন আগামী রোববার পর্যন্ত যে বাঁচবো এর নিশ্চয়তা নেই। আজই তাই আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ডায়ালাইসিসের আগের দিন এমন হয়। কারণ শরীরে পানি বেড়ে যায়। রক্তে ক্রিটিনাইন ও পটাশিয়াম বেড়ে যায়। এখন যে ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস নেব তারও তো পয়সা নেই। আমি অসুস্থ হওয়ায় বউ সারারাত অর্ডারি প্রতি পিছ পাঁচ টাকা হারে ব্যাপারির নতুন মশারি সেলাই করে যে টাকা আয় করে তাই দিয়ে আমার সংসার ও চিকিৎসা ব্যয় চালানো হয়। এখন ক্লিনিকে গেলেই পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হবে। এতো টাকা কোথায় পাবো?
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সামেক হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার শীতল চৌধুরী জানান, অদক্ষ ব্যক্তি দ্বারা মেশিন পরিচালনা করায় সব ডায়ালাইসিস মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মোট কতটা মেশিন আছে আর নষ্ট মেশিনের সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্ভবত আমাদের মোট ডায়ালাইসিস মেশিন ১৯টি যার মধ্যে বর্তমানে তিনটি সচল আছে।
নষ্ট মেশিনগুলো মেরামত প্রক্রিয়া কোন পর্যায়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এটাতো দীর্ঘ প্রসেসের ব্যাপার, মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে, মেরামতের জন্য কয়েক দফায় টেকনিশিয়ানও এসেছে কিন্তু খুচরা যন্ত্রাংশ না পাওয়া যাওয়ায় মেশিন গুলো ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে নষ্ট মেশিনগুলো দ্রুত মেরামত করার চেষ্টা করছি বলে জানান তিনি।
খুলনা গেজেট/এনএম