খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলায় ৩ পুলিশ বরখাস্ত, গ্রেপ্তার ৭
  ভারতীয় সব বাংলা চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ চেয়ে করা রিটের শুনানি বুধবার
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির বছরে ব্যয় ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা

বেতন-গাড়ি সবই আছে, শুধু গ্রাহক নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাকরি আছে, বেতন আছে, আছে দামি গাড়ি।  শুধু কাজটা নেই। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, তবে পা পড়ে না কোনো সেবাগ্রহীতার। বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে আসেন, খোশগল্পে মাতেন। বিকেল হলে বাসার পথ ধরেন। এটি সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিত্যদিনের ছবি।

খুলনা-বরিশাল বিভাগসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের জন্য ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর গঠন করা হয় সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও খুলনাবাসীর সেই আশা পূরণ হয়নি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে খুলনাসহ ১৯টি জেলাতেই গ্রাহক তৈরি করতে পারেনি পেট্রোবাংলা নিয়ন্ত্রিত সংস্থাটি। খুলনায় গ্যাসের গ্রাহক না থাকলেও কোম্পানির আলিশান ভবন আছে। কর্মকর্তাদের জন্য আছে গাড়ি। রয়েছে ৫৮ জন কর্মকর্তাসহ কর্মচারীর বিশাল বহর। বেতন-ভাতাসহ পরিচালন খাতে কোম্পানির বছরে ব্যয় ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিশাল জনবল ও বিপুল ব্যয় সত্বেও কাংখিত গ্যাস না পাওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ খুলনার মানুষ।

খুলনা বিভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রাকৃতিক গ্যাস নেই। দেশের অন্য গ্যাসক্ষেত্র থেকেও এ অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। স্বল্পমূল্যের জ্বালানির অভাবে এসব জেলায় ভারী শিল্পে বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। এ পটভূমিতে দক্ষিণাঞ্চলে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন খুলনার মানুষ।

২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দক্ষিণাঞ্চলে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় (খুলনা বিভাগের ১০, বরিশালের ৬ জেলা এবং ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুর) গ্যাস সরবরাহের জন্য ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর সেখানে যায় সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। তবে গেল ১৫ বছরে ভোলা ও কুষ্টিয়া ছাড়া অন্য ১৯ জেলায় গ্যাস সংযোগই দিতে পারেনি কোম্পানিটি। এসব জেলায় কোম্পানির কোনো গ্রাহক নেই, ফলে সেখানে নেই কাজও। কর্ম না থাকলেও আছে বিশাল জনবল বহর। শুধু খুলনার কেন্দ্রীয় কার্যালয়েই জনবল সংখ্যা ১৩১। এর মধ্যে ৫৮ জনই কর্মকর্তা। কর্মহীন এ অফিসে বছরে খরচ হচ্ছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ৮৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা এবং প্রশাসনিক ও অফিস পরিচালনে মাসে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা খরচ হয়।

গ্রাহক মাত্র ২,৩৯১

সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির ৯৫ শতাংশ কাজ ভোলা ঘিরে। ভোলার দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ওই এলাকার আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহককে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর বাইরে কুষ্টিয়ার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও দুটি শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কোম্পানির গ্রাহক ২ হাজার ৩৯১ জন। এর মধ্যে কুষ্টিয়ায় মাত্র ৪। বাকি ২ হাজার ৩৮৭ গ্রাহক ভোলায়। আবার ভোলার ২ হাজার ৩৭৪ গ্রাহক আবাসিক।
সূত্রটি জানায়, কুষ্টিয়া বিসিকের দুটি এবং খুলনার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন টানা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ গ্যাস সরবরাহ হবে বলতে পারেননি কোম্পানির কর্মকর্তারা। এর আগে ‘দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপন’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় খুলনার আড়ংঘাটা পর্যন্ত স্থাপন করা হয় গ্যাস পাইপলাইন। এরপর ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের কাজ।

জনবলের বহর

কাজ না থাকলেও জনবলে ঠাসা সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, কোম্পানির বর্তমান জনবল ২৩৪ জন। এর মধ্যে কর্মকর্তা ৭৯, স্থায়ী কর্মচারী ১৭ এবং আউটসোর্সিং নিয়োজিত কর্মচারী আরও ১৩৮ জন। কর্মকর্তাদের মধ্যে ১১ জন রয়েছেন প্রেষণে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিভাগীয় সদরদপ্তর হওয়ায় খুলনায় কোম্পানির প্রধান কার্যালয়। এখানেই কর্মরত ১৩১ জন। এর মধ্যে কর্মকর্তা ৫৮, কর্মচারী ৯ এবং আউটসোর্সিংয়ে আছেন ৬৪ জন। গ্রাহক না থাকায় কর্মকর্তাদের কোনো কাজ নেই। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসের বেশির ভাগ দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। উপব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাজও সইয়ের বৃত্তে সীমাবদ্ধ। বেশির ভাগ কর্মকর্তাই অফিসে আসেন, গল্পগুজব করে চলে যান। গ্রাহক না থাকায় সেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা নেই। কার্যালয় ভবনে কে কী করেন, সেটা দেখারও কেউ নেই।
কোম্পানির রয়েছে ১৯ গাড়ি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপকরা পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করেন। উপমহাব্যবস্থাপকরা প্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে গাড়ি সুবিধা পান।

কাজ নেই কেন?

গ্যাসের গ্রাহক তৈরি হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা সরকারের জ্বালানি নীতিকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক আবাসিক, বাণিজ্যিক ও সিএনজি শ্রেনিতে নতুন সংযোগ বন্ধ রয়েছে। আবার পরিকল্পিত শিল্প নগরী ছাড়া শিল্প শ্রেণিতেও নতুন সংযোগ বন্ধ।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির অধিভুক্ত এলাকায় জাতীয় গ্যাস গ্রিডের নিচের দিকে থাকায় এখানে গ্যাসের চাপ কম থাকে। যর কারণে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা এবং খুলনার ২২৫ মেগাওয়াটসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সংকটের পাশাপাশি দক্ষিণের জেলাগুলো গ্যাস পৌঁছাতে কোম্পানির নিজস্ব উদ্যোগের অভাব রয়েছে। ভোলার দুটি ক্ষেত্র থেকে শুধু ওই এলাকাতেই গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ভোলা থেকে আশপাশের অন্য জেলাতে গ্যাস সরবরাহের দূরদর্শী কোনো উদ্যোগ নেই কোম্পানির।

ক্ষুব্ধ খুলনার মানুষ

পাইপলাইনে খুলনার শিল্প-কলকারখানায় গ্যাস না আসায় ক্ষুব্ধ খুলনার মানুষ। তারা দ্রুত গ্যাস সরবরাহের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ ব্যাপারে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, গ্যাস সংকট থাকলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিল্পকারখানায় নতুন সংযোগ বন্ধ নেই। ঢাকা, চট্টগ্রামে সংযোগ দেওয়া হলে খুলনা বাদ যাবে কেন? তিনি বলেন, এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে সেই গ্যাস খুলনা আনার বিষয়ে সুন্দরবন কোম্পানির জোরালো পদক্ষেপ নেই। কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাবে কোম্পানির কার্যক্রম কাগজে-কলমে থেকে গেছে।

এমডির ভাষ্য

সার্বিক বিষয় নিয়ে কোম্পানির এমডি তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য জানতে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে তিন দফায় কোম্পানি প্রধান কার্যালয়ে যান প্রতিবেদক। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও এমডির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। কোম্পানির অন্য কর্মকর্তারাও সরাসরি গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। পরে প্রশ্ন পাঠালে তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য দেন এমডি।

তাতে কোম্পানির ব্যর্থতার বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে সফলতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়েছে, ভোলা ও কুষ্টিয়ার ২ হাজার ৩৯১ গ্রাহককে বর্তমানে দৈনিক ৯০-১১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে ভোলা সদর ও বোরহানউদ্দিন উপজেলায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। খুলনার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিতে পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। দ্রুত সেখানে গ্যাস যাবে। ভবিষ্যতে ভোলার একটি টেক্সটাইল মিল, খুলনা, যশোর ও ঝিনাইদহ বিসিক শিল্পনগরীতে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা আছে।

 

খুলনা গেজেট/েএইচ

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!