গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ইতিহাসে প্রথম মহিলা সচিব পদে পদোন্নতি নিয়ে স্বাস্থ্য সচিব হিসেবে যোগদান করার পর যেদিন প্রথম অফিসে এলেন ১৫ তম বিসিএস ক্যাডারের চৌকস অফিসার আফসানা আক্তার নীলা সেদিন অফিসের তথা সমগ্র সচিবালয়ের বাতাস কেমন যেন ভিন্নরূপে বইতে শুরু করলো। বরাবরের ন্যায় বিদায়ী সচিব মহোদয়কে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের বিশাল ফুলের মালা কনফারেন্স হলে আগেরদিন থেকে শোভা বর্ধন করছে। পাশের রূমে কাপ-পিরিচের ঠুং ঠাং আওয়াজ, কে কে বক্তৃতা দিবেন তার তালিকা, অতিরিক্ত সচিব থেকে শুরু করে পার্সোনাল অফিসারের টেবিল পর্যন্ত সকলে বিশেষ ব্যাস্ত সময় কাটিয়েছেন প্রায় ৩/৪ দিন। পুরনো ফাইল পত্র আপ-টু ডেট করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রকৃত পক্ষে কোন কাজ এ ক’দিন কোনটিই সঠিকভাবে হতে দেখা যায়নি। দর্শনার্থীদের সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র কিছু কিছু ঠিকাদার বিশেষ পাশ নিয়ে বিশেষ কারণে বিশেষ অফিসারের সাথে দেখা করার বিশেষ অনুমতি পেয়েছে। বিশেষ ঠিকাদার বিশেষ অনুমতিক্রমে বিশেষ অফিসারের সাথে বিশেষ ভাবে বিশেষ ব্রিফকেচসহ সাক্ষাৎ শেষে বিশেষ জরুরীভাবে বিশেষ ফাইল নিস্পত্তি করে বিশেষ তৃপ্তি সহকারে বিদায় নিয়ে সচিবালয় ত্যাগ করে যাবার সময় আর্ডালি, ড্রাইভার পিয়নদের সাথে বিশেষ কাজটি করতে ভুল করছে না।
অবশেষে বিশেষ বিশেষ সকল ক্রিয়া কর্ম সম্পাদন করে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায়ী সচিব মহোদয়কে শেষ বিদায় জানিয়ে নবাগত সচিব মহোদয়কে তৈলাক্ত মর্দনের পালা শুরু হলো। অতিরিক্ত সচিব থেকে শুরু করে পিয়ন অর্ডারলী পর্যন্ত একে একে পরিচিত হতে হতে সেদিন বিকাল ৫ টা পর্যন্ত অফিসের কোন ফাইলের কাজ করা হলো না। নবনিযুক্ত সচিব মহোদয় ভদ্রতা ও অফিসের চিরাচরিত রীতি রক্ষা করে সকলের সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন। শুধু একটি বিষয়ে মারাত্মক অনিয়ম করলেন। বিকাল ৫ টার পর যখন কুশল বিনিময় শেষ হলো তখন ঐ দিনের নির্ধারিত সকল ফাইলপত্র টেবিলে দেবার জন্য প্রাইভেট সেক্রেটারীকে নির্দেশ দিলেন। পি.এস. তখন অফিস ত্যাগের জন্য আজকের বিশেষ ভারী ব্রিফকেচটি ইতোমধ্যে বেশ যাচাই পূর্বক লক করে টাই ও বেল্ট শক্ত করে বেঁধে মুখে একটু স্নো মেখে প্রস্তুত। সচিব মহোদয়কে বিদায় দিয়েই তিনি গাড়ীতে উঠবেন। যাবার সময় ভারী ব্রিফকেচটি বসুন্ধরার অফিসে গিয়ে খালি করবেন। কারণ আজ সেখানে ফাইনাল কিস্তি পরিশোধ করে প্লটের জায়গা যত দ্রুত সম্ভব স্ত্রীর নামে রেজিষ্ট্রী করে স্ত্রীর ভালবাসা ও ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ স্থায়ী করবেন।
ইন্টারকম বেজে উঠলো। ভিতর থেকে সচিব মহোদয় বললেন- ‘কি ব্যাপার, তাড়াতাড়ি ফাইল আনুন। ড্রাইভার, বডিগার্ড কষ্ট পাবে, বেশী দেরী করা যাবেনা।’
পি.এস.- ‘কিন্তু স্যার……., ম্যাডাম…… আজতো কোন ফাইল আসেনি। সকল সেকশনে খোঁজ নিলাম কিন্তু কোন ফাইল রেডি নেই। প্রায় সকল সেকশনের লোকজন চলে গেছে।’
সচিব মহোদয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনার কাজ থাকলে আপনিও যেতে পারেন।’ এই বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন রেখে দিলেন। পি.এস. কি করবেন তা বুঝে ওঠার আগেই স্বাস্থ্য বিভাগের ডি.জি. মহোদয় পি.এস. এর রূমে ঢুকে বললেন-‘রাস্তায় ভীষণ জ্যাম থাকায় দেরী করে ফেলেছি। সচিব মহোদয় কি মনে করবেন। আপনি দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলুন, আমি সাক্ষাৎ প্রার্থী।’
সামান্য আগে ফোন রাখবার শব্দটা পি.এস. এর কানে বাজছে। কিন্তু কী করবেন। উভয়ই তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গলার টাইটা পূর্বের মত ঢিলা করে সচিব মহোদয়ের রূমে ঢুকে কাঁশতে কাঁশতে ডি.জি. মহোদয়ের আগমনের খবর দিলেন। সচিব মহোদয় সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
ডি.জি. মহোদয় রুমে প্রবেশ করে সালাম বিনিময় শেষে স্যার বা ম্যাডাম দু’টোই উহ্য রেখে রাস্তায় ভীষণ জ্যাম হেতু বিলম্বে আগমনের বিশাল বর্ণনা দিলেন। পরিচয়ের প্রথমেই নাম একটি বিশেষ পর্ব। তাই একটু রাশ ভারী কায়দায় বললেন-‘আমার নাম ডাঃ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম।’ ডিগ্রি বলার আগেই সচিব মহোদয় তাকে থামিয়ে দিয়ে বসতে বলার পর বললেন-‘কি খাবেন, চা না কফি?’ কলিং বেল টিপলেন কিন্তু পিয়ন এলো না। এলেন পি.এস. স্বয়ং। সচিব মহোদয় বললেন-‘আপনি কেন, পিয়ন নেই?’
পি.এস.- ‘পাঁচটার পরে ওরা কেউ থাকেনা।’
ডি.জি. মহোদয় এসব জানতেন বিধায় ভদ্রভাবে বললেন-‘না, থাক। কিছু দরকার নেই। পরের দিন খাব। আজ শুধু কথা বলি।’
‘ধন্যবাদ’। আপনি কোন্ সালে ডাক্তারী পাশ করেছেন? কোন্্ মেডিক্যাল কলেজ থেকে? এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি কোথায় করেছিলেন? তখন মেডিকেলে ভর্তি কম্পিটিশন কেমন ছিল? আপনি নিজের ইচ্ছায় ডাক্তার হয়েছিলেন, না মা বাবার ইচ্ছায়? ছোটবেলা থেকেই কি ডাক্তার হবার শখ ছিল?
এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে ডি.জি. মহোদয় একটি একটি করে উত্তর দিতে শুরু করলেন। সচিব মহোদয় তার সকল উত্তর মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। ডি.জি. মহোদয় বলেও বেশ তৃপ্তি পাচ্ছিলেন। একেতো নিজের জীবনের গর্বের বর্ণনা, তারপর একজন সুন্দরী মহিলা বস্্ শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেতো চাটটে খানি কথা নয়। তাইতো তিনি সত্য মিথ্যায় বাড়িয়ে হাত-পা, নোক্তা দিয়ে মুখোরোচক বর্ণনা দিতে দিতে এক সময় লক্ষ্য করলেন বস যেন কিছুই শুনছেন না। তাই একটু নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে মেডিকেলে ভর্তি হবার কম্পিটিশন সম্পর্কে আলোচনা তুললেন। বি.সি.এস. পাশ করা মেডিকেলে ভর্তির তুলনায় তেমন কিছুই নয়। এ কথাও বলতে ভুল করলেন না। তাদের সময় যেসব ছাত্র-ছাত্রী মেডিকেলে চাঞ্চ পায়নি তারা ডিগ্রি পাশ করে অনায়াসে এক চাঞ্চে বি.সি.এস. পাশ করে অনেকেই ফরেন ক্যাডার, এ্যাডমিন, কাস্টম্্স ক্যাডারে গেছে। আজ তাদের অনেকেই সচিব। কিন্তু ডাক্তারদের সচিব হবার কোন সুযোগ নেই। এটা সরকারের কিছুটা বৈষম্যমূলক আচরণ। নিজের কখনও ডাক্তার হবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছায় ডাক্তারী পড়েছিলেন। সচিব মহোদয়ের প্রশ্নের শেষ উত্তর ছিল এইটিই। তাই তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে ডি.জি মহোদয়কে বিদায় দিলেন এবং পি.এস. কে চলে যেতে অনুমতি দিলেন।
সচিব মহোদয় ডি.জি. সাহেবের ঠেলামারা কথায় বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলেন না। তিনি শুধুমাত্র বি.এ পাশ কিন্তু বি.সি.এস পরীক্ষায় তার সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মত। পি.এ.টি.সি-তে তিনি সকলকে হার মানিয়ে রীতিমত ঈর্শনীয় ফল অর্জন করেছিলেন। সেখানে প্রায় সকল অনুষ্ঠানে তিনি গান গেয়ে, সকল বিভাগীয় পরীক্ষায় বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়ে ও অন্যান্য প্রতিভা প্রদর্শণ করে সকলের নজরে এসেছিলেন। তাই একজন মহিলা অফিসার হয়েও বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বয়সে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন। এজন্য তাঁর কোন অহংকার ছিল না, তবে মনে মনে ছাত্র জীবনের পাঠ্যক্রম বহিঃভর্‚ত কর্মকান্ডের জন্য কিছুটা গর্ববোধ করতেন।
সন্ধ্যা সমাগত। ড্রাইভার, বডিগার্ড ছাড়া আর কেউ তখন অবশিষ্ট ছিল না। কলিং বেল টিপে তাদের ডেকে গাড়ীসহ তাদেরকেও ছুটি দিয়ে দিলেন। অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সবাই হতবাক। কিন্তু প্রথম দিন বিধায় কেউই মতি গতি না বুঝে কোন কথা বলার সাহস করছিল না। কিন্তু ড্রাইভার, বডিগার্ডের চাকরীর চিন্তা অনেক বেশী। তাই সাহস করে অফিস ত্যাগ না করে গাড়ীর মধ্যে বসে বসে মশার পেটে নিজের রক্ত হজম করাতে থাকলো সচিব মহোদয়ের অগচোরে।
সদ্য যোগদানকৃত সচিব মহোদয় এখন আর সচিব রইলেন না। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই তিনি ফিরে গেলেন তার গ্রামের বাড়ীতে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন তাঁর পরলোকগত মা-বাবাকে। তাঁর মা-বাবার চিরকালের শখ ছিল-তাঁদের মেয়ে বড় ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। কিন্তু তা না হয়ে সরকারী বড় অফিসার হলো। অবশ্য এত বড় যে হবে তা তাঁদের কখনও মনে হয়নি। যখন সকল বাঁধা পেরিয়ে নিজ যোগ্যতাবলে তাঁদের নীলা সরকারী চাকরীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছেন তখন তাঁরা আর ইহজগতে নেই। নীলার মনেও চিরদিন ডাক্তার হতে না পারার কষ্ট ছিল। কারণ তারও ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবেন এবং মা-বাবার মনের আশা পূরণ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য এস.এস.সি ও এইচ. এস. সি পরীক্ষায় যে পরিমান মার্ক থাকার প্রয়োজন ছিল তা তিনি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যর্থতার জন্য তিনি ও তাঁর মা-বাবা অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন তবে আশাহত ছিলেন না। কারণ আশাতীত ফল না হবার কারণ তিনি নিজেই ছিলেন। উভয় পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার জন্য যতটা পরীক্ষার পড়া করা দরকার, তিনি মেধা থাকা স্বত্তেও তা করতেন না। তাঁর বেশী ঝোঁক ছিল মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে পাঠ্যক্রম বহিঃর্ভূত পুস্তক পাঠ করা, স্কুল কলেজে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করা, বিতর্ক ও ক্রিড়া প্রতিযোগীতায় ১ম স্থান অধিকার করা, এলাকায় কোন সেবামূলক কার্যক্রমের খবর পেলে সবার আগে সেখানে হাজির হয়ে সার্বিক সহায়তা করা, গল্প ও কবিতা লেখা, গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরীব ও দুস্থ মানুষের সেবা করা, এলাকায় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে সেখানে নাচ-গান করা ইত্যাদি। পাঠ্যক্রমে যতটা আগ্রহ ছিল তার চেয়ে বেশী মনোযোগ ছিল অন্যান্য কাজে। তাঁর মা মনে মনে খুশী হলেও বাবার সাথে মাঝে মাঝে এসব নিয়ে মনোমালিন্য হতো। বাবার ধারণা ছিল তাঁর মেয়ে ইচ্ছা করেই তার ভবিষ্যত নষ্ট করছে। এ নিয়ে আদরের মেয়েকে তেমন কিছু না বললেও যত রাগ মেয়ের মায়ের উপর ঝাড়তেন। অনেক সময় তাঁর মা স্বামীর অগোচরে মেয়েকে বুঝাতে চেষ্টা করতেন। মেয়ে তার মায়ের সাথে তর্ক করতো না, তবে সব উপদেশ পুরোপুরি পালন না করে আবারও একই কাজ করতো।
নীলার মন এই মূহুর্তে পুরোপুরি গ্রামে। ছাত্র জীবনের ডাক্তার হবার প্রবল ইচ্ছা ও তখনকার অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। আজ শুক্রবার। কয়েকদিন আগে থেকেই মাইকে শুনে আসছে আজকের দিনটির কথা। পাশের গ্রামের তার এক দূর সম্পর্কের অনেক বড়লোক ব্যবসায়ী চাচা চক্ষু শিবিরের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে প্রায় এক দেড় হাজার গরীব লোকের চোখের চিকিৎসা করা হবে। নীলা ও তার বন্ধু-বান্ধবীদের দায়ীত্ব দেওয়া হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। নীলা আয়োজক চাচাকে মনে প্রাণে সম্মান করে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে মায়ের অনুমতি নিয়ে চক্ষু শিবিরে হাজির হয়েছে। শত শত গরীব দুঃখী মানুষ চোখের চিকিৎসার জন্য ভোর বেলা এসে হাজির। তাদের সবাইকে নিজের হাতে হাত ধরে লাইনে দাঁড় করানো, ¯িøপ দেয়া, একজন ডাক্তারের দেখা শেষ করার পর পরবর্তী ডাক্তারের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করানো, কাউকে ঔষধ বা চশমা দেয়া, আবার কাউকে অপারেশনের জন্য আলাদা করে রাখা ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে সকল স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে পরম তৃপ্তি সহকারে করে চলেছে নীলা। এতে তার একটুও ক্লান্তি লাগছে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে একবারও বিশ্রাম নেয়নি। এমনকি দুপুরের খাবার খেতেও যায়নি। কোনমতে কিছু বিস্কুট, সিঙ্গারা, চা খেয়ে সন্ধ্যা অবধি একটানা সেবা করে আজ সে পরম তৃপ্ত। ডাক্তার না হয়েও ডাক্তারী করার মত আনন্দ পাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার আয়োজক চাচা ঘুরে ঘুরে তাদের সেবা দেখছেন তাতে নীলার আগ্রহ দ্বিগুণ তিনগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তার বন্ধু বান্ধবীরাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে সেবা করে যাচ্ছে। তার দেখাদেখি প্রায় সকলেই না খেয়ে রোগীদের সেবা দিতে লাগলো। অনেক গরীব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের সেবায় খুশী হয়ে কেঁদে ফেললেন। কেউ কেউ বললেন-ডাক্তারের চিকিৎসার চেয়ে ছেলেমেয়েগুলোর আদর যত্নে অর্ধেক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। নীলার বান্ধবী সীমাও তার সাথে সেবা করছে। তাই সীমার বৃদ্ধ দাদা লাইন ভেঙ্গে ভীড়ের ভয়ে আগেভাগে ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে এলেন। কিন্তু সীমা নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করে আবার লাইনে পাঠিয়ে দিল। সীমার দাদা পুরনো দিনের শিক্ষিত ও জ্ঞানী লোক। তাই নিজের ভুলের জন্য নাতনীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে এমন আদর্শ নাতনীর দাদা হবার গর্বে পুনরায় লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নীলাও সীমার সাথে নিয়ম রক্ষার ব্যাপারে আপোষহীন মনোভাব পোষণ করলো। তারও দু’চারজন পরিচিত লোক গোপনে সুযোগ নিতে চেয়েছিল কিন্তু প্রত্যেকে ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাংলাদেশের স্বজনপ্রীতি প্রথম বারের মত এখানে পরাভূত হলো। সন্ধ্যার পরও রোগী আসতে থাকলো কিন্তু ডাক্তারদের ক্লান্তিতে সেবা কার্যক্রম আজকের মত বন্ধ হলো। স্কুল ঘরে সাজানো প্রায় একটি ছোট খাটো চক্ষু হাসপাতালের বিশাল আয়োজনের সকল যন্ত্রপাতি গাড়ীতে তুলে দিয়ে নীলা যখন রাস্তায় এলো তখন দেখে তার মা তাকে বাড়ী নেবার জন্য অপেক্ষা করছেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়ী পৌঁছে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে বাবা বাড়ী ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়লো। কাল আবার এই একই স্বেচ্ছাসেবক দলের সাথে এলাকা ভ্রমনে বের হতে হবে এবং শহরের হাসপাতালে যেসব রোগীদের চক্ষু অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়েছে তাদের দেখতে যেতে হবে। বাবা বাড়ী আসার পর তার সাথে কথা হলে নিষেধাজ্ঞা জারী হবার সম্ভাবনা আছে। তাই ঘুমিয়ে পড়াই নিরাপদ ও অন্ততঃ আজকের সারাদিনের ক্লান্তির জন্য স্বাস্থ্য সম্মত।
দ্রæত বিচানায় গিয়ে ঘুমের ভান করলো কিন্তু সহজে ঘুম এলোনা। সারাদিনের সেবার গর্বে গর্বিত হতে থাকলো এবং আগামীকালের কর্ম পরিকল্পনার নানা ছবি মনের মধ্যে আঁকতে থাকলো। এর মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়লো তা সে টের পেলনা।
সকাল ঠিক ছ’টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাবা ঘুম থেকে উঠার আগেই গোসল করে মায়ের সাথে পুরনো কায়দায় নতুন যুক্তি করে আটটার আগেই বেরিয়ে গেল। সবার আগে নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হয়ে শিক্ষা সফরে সামিল হল। সারাদিন হই হল্লা করে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে শিক্ষা সফর শেষে সন্ধ্যার আগে হাজির হলো হাসপাতালে পাঠানো রোগীদের কাছে। সেখানে যাবার পর সকল রোগী এতগুলো ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখে অপারেশনের ভয় এবং মনের আনন্দে প্রায় সকলে আবার কেঁদে ফেললেন। নীলা ও তার সাথীরা সকল রোগীর মাথায় হাত বুলিয়ে শ্বান্তনা দিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব কোমলমতি ছেলেমেয়েদের গতকালের সেবার মান নিয়ে ভ‚য়সী প্রশংসা করলেন। তাদের জন্য কিছু সৌজন্য উপহার দিয়ে সকলের সামনে ঘোষণা দিলেন যে, এই সেচ্ছাসেবক দলের সদস্যদের জন্য তাদের ক্লিনিক বিনা পয়সায় আজীবন চিকিৎসা দেবে। ডাক্তারদের ব্যবহারে এবং ঘোষণায় সকলে ভীষণ খুশী হলো এবং তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও আবার একসাথে ভিজতে ভিজতে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। সচিবালয় তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। নীলা আবার সচিব হয়ে গেলেন। জনাবা আফরোজা আক্তার নীলা কোনমতে দরজা পর্যন্ত এসে দরজা খুলে বাইরে এলেন। লিফ্্ট না চলায় সিঁড়ি দিয়ে হেটে নিচে এলেই ড্রাইভার ও বডিগার্ড গাড়ীর দরজা খুলে স্যালুট করলো। তিনি অবাক হলেন। কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও এত সময় ধরে গ্রামের জগতে থাকায় মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না। তখনও সেই সেবাদান করা আনন্দের দিনগুলো তাঁর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
তিনি গাড়ীতে উঠে বসলেন। ড্রাইভার গাড়ী চালিয়ে তাঁর বাসভবনের দিকে রওয়ানা হলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে বাসায় যেতে ভীড় কম হয়, তাই ড্রাইভার ঐ পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে গাড়ী ঢাকা মেডিকেলের সামনে পৌঁছালো। সচিব মহোদয় মেডিকেলের গেইটের সামনে গাড়ী থামাতে নির্দেশ দিলেন এবং ড্রাইভার, বডিগার্ডকে গাড়ীসহ ছুটি দিয়ে তিনি হাসপাতালে ঢুকলেন। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনলো না।
স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পদে সদ্য যোগদান করা এই মহা ক্ষমতাধর মানবী নিতান্ত সাধারণভাবে একজন সাধারণ রোগীর এ্যাটেনডেন্টের ছদ্মবেশে সমস্ত ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলেন। তিনি আবার নীলা হয়ে গেলেন। সেখানে যে রোগীকে অসহায় অবস্থায় দেখলেন তাকেই খোঁজ খবর নিলেন। কোন কোন গরীব রোগীর হাতে সাধ্যমত কিছু টাকাও গোপনে গোপনে দিলেন। দুই তিনটি ওয়ার্ড ঘুরে তিনি গেলেন জরুরী বিভাগে। সেখানে ডাক্তারের তুলনায় রোগীর আধিক্য দেখে নিজে কয়েকজনকে লাইনে দাঁড়াবার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তুললো না। মনে পড়ে গেল-চক্ষু শিবিরের সীমার দাদার কথা। অবশ্য সেখানে তাঁর ক্ষমতা ছিল অনেক বেশী। কিন্তু এখানে তার কথা কে শুনবে। এটাতো বাংলাদেশ। অনিয়ম এখানে প্রচলিত নিয়ম। সত্যিকারের লাইনে দাঁড়াতে গেলে সে রোগীর আর ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছা লাগবে না। লাইনে দাঁড়িয়েই নিয়ম রক্ষা করে মরতে হবে এ কথা তাঁরও জানা আছে। মনে মনে বললেন-হায়রে আফরোজা আক্তার! মাননীয় সচিব! তোমার চেয়ে নীলার ক্ষমতা একদিন অনেক বেশী ছিল। তখন সে সকলকে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করতে পারতো, কিন্তু আজ সে অসহায়।
জরুরী বিভাগের সামনে একটি সি.এন.জি. বেবী টেক্সী থেকে একজন অজ্ঞান রোগী নামিয়ে রেখে দ্রæত পালিয়ে গেল। লোকটির বেশ ভূষা দেখে বনেদী বড়লোক বলে মনে হয়। বেশ কিছু লোক উৎসুক হয়ে মেঝেতে শোয়ানো অজ্ঞান ভদ্রলোকটিকে দেখছে। জরুরী বিভাগের ডাক্তার সাহেবও দেখছেন। এসব দেখতে ডাক্তার সাহেবরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তাই তেমন আমলে নিলেন না। বে-ওয়ারিশ রোগীর চিকিৎসা দেবার মত সময় তাদের কোথায়। কত মানুষ টাকা দিয়ে, ক্ষমতা দিয়েও চিকিৎসা পায়না। তাতে আবার বে-ওয়ারিশ রোগী।
সচিব মহোদয় লোকজনের ভীড় দেখে সেখানে গেলেন। লোকটি অজ্ঞান অবস্থায় উবু হয়ে পড়ে আছে দেখে জরুরী বিভাগের ডাক্তারকে দেখবার জন্য অনুরোধ করলেন। ডাক্তার বললেন- ‘এসব রোগীর দায়িত্ব নেয়া ঝামেলার কাজ। পুলিশী হাঙ্গামার কারণ হতে পারে। বে-ওয়ারিশ রোগীর দায়ীত্ব আমি নিতে পারবো না।’
সচিব মহোদয় বললেন-‘আমি তার দায়ীত্ব নিলাম। দয়া করে আমার নাম লিখে তাকে দ্রæত চিকিৎসা দিন।
কথা শেষ করেই অন্য একজনের সাহায্য নিয়ে তিনি নিজেই ধরাধরি করে লোকটিকে স্ট্রেচারে তুলে টেবিলের উপর চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। মুখের দিকে তাকাতেই তিনি অবাক হলেন। দেখলেন-তারই গ্রামের সেই ধনী ব্যবসায়ী চাচা, যিনি তাঁর ছাত্রজীবনে বহু দরীদ্র রোগীর চিকিৎসা করাতে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির আয়োজন করতেন। যাকে তিনি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর এমন দশা কি করে হলো? নিজের অজান্তে তিনি কেঁদেও ফেললেন। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হলেও তিনি পারলেন না। শুধু ডাক্তার সাহেবকে যথাসাধ্য বুঝাবার চেষ্টা করলেন এবং যত টাকা লাগে তাকে উন্নত চিকিৎসা দেবার জন্য অনুরোধ করতে থাকলেন। কিন্তু ডাক্তার বাংলাদেশী সরকারী হাসপাতালের চিরাচরিত রীতিতে কাজ করছেন।
ড্রাইভার ও বডিগার্ডকে হাসপাতালের গেইট থেকে বিদায় দিয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু তারা যাননি। গাড়ী আড়ালে রেখে দূর থেকে বসের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। বসের কান্না ও ডাক্তারের অবহেলা সবকিছুই এতক্ষন তারা দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে। এবার চাকরী ও ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করে আস্তে আস্তে ডাক্তার সাহেবের কানে কানে গিয়ে বললে-‘আপনার সামনে স্বাস্থ্য সচিব মহোদয় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর রোগীকে ঠিকমত চিকিৎসা করুন।’
ডাক্তার আগে থেকেই ড্রাইভার ও বডিগার্ডকে চিনতেন, কিন্তু সচিব মহোদয়কে আজ প্রথম দেখলেন। তাও ক্রন্দনরত অবস্থায়। চাকরী আছে কি নেই, একথা ভেবে রীতিমত হাক ডাক শুরু করে দিলেন। নার্স, আয়া, বড় ডাক্তার, ছোট ডাক্তার, মেঝো ডাক্তার সকলকে ডেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। বিদ্যুতের মতো সমস্ত হাসপাতালসহ ডি.জি. সাহেব পর্যন্ত খবর ছড়িয়ে পড়লো। ঝাঁকে ঝাঁকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় সকল কর্মকর্তা হাজির হলেন। ঢাকা শহরের অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিকে ভাড়ায় খাটা সকল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ হাসপাতালে হাজির হলেন। রোগীকে প্রথম শ্রেণীর কেবিনে নিয়ে চিকিৎসা দিতে শুরু করলেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের হস্তক্ষেপে অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর জ্ঞান ফিরে এলো। কিন্তু চোখ মেলতে কষ্ট পাচ্ছিল। ডাক্তারগণ বললেন-‘একটু গরম দুধ খাওয়াতে হবে। তাকে কথা বলতে দেওয়া ঠিক হবেনা। কারণ তিনি অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছিলেন। চিন্তার কোন কারণ নেই। দুধ পান করার পর ঘুমিয়ে গেলে সকাল নাগাদ রিলিজ করা যাবে। তখন তার কাছে বিস্তারিত শুনে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
মুহুর্তের মধ্যে ফ্লাক্স ভর্তি গরম দুধ এলো। নার্সের হাত থেকে চামচ নিয়ে ডাক্তার সাহেব নিজেই দুধ পান করাতে চাইলেন। কিন্তু রোগীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সচিব মহোদয় এত সময় তার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছেন। এবার চামচ দিয়ে দুধ পান করাতে শুরু করলেন। রোগী চোখ বুঝে দুধ পান করতে লাগলো। সকল ডাক্তারগণ নিশ্চিন্ত হলেন।
সচিব মহোদয় সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে যার যার কাজে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন এবং শুধুমাত্র একজন নার্সকে তাঁর সাথে রাখতে বললেন। কেউ কোন প্রশ্ন করতে সাহস করলেন না। আমতা আমতা করে একে একে সবাই বিদায় নিলেন। সারারাত নার্সের সাথে একপায়ে দাঁড়িয়ে তিনি রোগীর মাথায় হাত বুলিয়ে চললেন। মাঝে কিছু হালকা খাবার আনিয়ে নিজে খেলেন এবং নার্সকেও খাওয়ালেন। এমনভাবে দাঁড়িয়ে সেবা করার অভ্যাস তাঁর ছাত্রজীবন থেকে আছে। এ অভ্যাস যার জন্য গড়তে পেরেছিলেন তিনিই আজ তাঁর রোগী। তাকে সেবা করতে পেরে তিনি আজ গর্বিত ও আনন্দিত। অবশ্য রাতের বেলায় মাঝে মাঝে নার্সকে বসিয়ে রেখে তিনি সাধারণ ওয়ার্ডে রোগীদের দেখতে গিয়েছিলেন। তাদেরকেও নিজের হাতে খাইয়ে পরম তৃপ্তি পেয়েছিলেন। ঐ রাতে হাসপাতালের সকল রোগী জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা পেয়েছিলেন। কোন ডাক্তার বা নার্স বিন্দুমাত্র চিকিৎসায় অবহেলা করেননি। প্রায় সকলেই জানতেন-আজ কোন ত্রæটি হলে তার নিস্তার নেই। অবশ্য সচিব মহোদয় কারো ত্রæটি ধরতে কোন চেষ্টা করেননি। তিনি শুধু নিজের হাতে সেবা করার তৃপ্তি উপভোগ করতে চেষ্টা করেছিলেন।
এভাবে সকাল হয়ে গেল। তাঁর শ্রদ্ধাভাজন চাচা ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখেন যেখানে শুয়ে আছেন সে জায়গা অপরিচিত। তিনি এখানে কিভাবে এলেন? তিনি তো এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ীতে করে রূপসী বাংলা হোটেলে তার বিদেশী বায়ারদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে দেখতে পেলেন না। তিনি ঘুম থেকে উঠার আগেই হাসপাতালের সকল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ সেখানে হাজির ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন-‘আপনারা কারা? আমার গাড়ী ও ড্রাইভার কোথায়?’
হঠাৎ করে তার মাথায় কোমল হাতের ছোঁয়া অনুভব করলেন। তাকিয়ে দেখলেন-নীলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ‘কি ব্যাপার নীলা, আমাকে এখানে কে এনেছে? তুমি এখানে কি করছো? এটা কোন জায়গা?’
সচিব মহোদয় আবারও কাঁদলেন। আস্তে আস্তে বললেন ‘আঙ্কেল আপনি সুস্থ হন, বাসায় চলেন। তারপর সব কথা শুনবেন। আমিও আপনার কথা শুনবো।’
এই বলে নিজেই হাত ধরে তাকে উঠিয়ে বসালেন। সবাইকে আবারও ধন্যবাদ দিয়ে তাঁর শ্রদ্ধেয় চাচাকে নিয়ে নিজের কাঁধের উপর আঙ্কেলের হাত নিয়ে গাড়ী পর্যন্ত গেলেন। উপস্থিত সকল ডাক্তার ও নার্স তাদেরকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
গাড়ী ছুটে চলেছে বাসার দিকে। সকাল বেলা রাস্তাঘাট যানযট মুক্ত। হঠাৎ করে বডিগার্ডের ওয়্যারলেসে শুনতে পেলেন পুলিশ কন্ট্রোলরূম থেকে বলছে-‘কাল রাতে বাংলামোটর থেকে একটি কালো রং এর জীপ গাড়ী উদ্ধার হয়েছে। যার ড্রাইভারের হাত পা বাঁধা ছিল এবং মুখে স্কচটেপ লাগানো ছিল। এখনও সে পুরোপুরি সুস্থ নয়। গাড়ী ও ড্রাইভার রমনা থানা হেফাজতে আছে।’ গাড়ীর নম্বর শুনে বুঝা গেল ঐ গাড়িটিই সচিব মহোদয়ের আঙ্কেলের।
বাসার দিকে না গিয়ে গাড়ী ঘোরালেন রমনা থানার দিকে। এত সকালে সচিবালয়ের গাড়ী থানায় ঢোকায় ডিউটি অফিসার দৌঁড়ে গিয়ে স্যালুট করে গাড়ীর মধ্য থেকে সকলকে নামিয়ে সরাসরি ও/সি সাহেবের রূমে বসতে দিলেন। বডিগার্ডের কাছে পরিচয় জানার সাথে সাথে ও/সি সাহেবকে সংবাদ দিলে তিনিও থানায় এলেন। সব বিবরণ শুনে গাড়ী ও ড্রইভারকে ফেরৎ দিলেন। একটি ডায়েরী নিজেই লিখিয়ে নিয়ে তাতে বাদীর স্বাক্ষর রেখে দ্রæত আইনগত কার্য সম্পন্ন করে সবাইকে আবার গাড়ীতে উঠিয়ে দিলেন।
উভয় গাড়ী বাসার দিকে ছুটে চললো। সচিব মহোদয়ের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। সারারাত নির্ঘুম থাকার কোন ক্লান্তি তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা গেলনা। বরং সদ্য যুদ্ধে জয়ের একটি আনন্দ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হলো। ছোট বেলার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন- ‘আঙ্কেল একটি গান শুনাতে মন চাইছে, শুনবেন?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে মিষ্টি সুরে গুণ গুণ করে গাইতে থাকলেন- ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’………।’ গাড়ী পৌঁছে গেল বাসায়। বাসায় ঢুকেই ড্রইং রূমে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স বসা দেখে আবারও অবাক হলেন। কি যে শান্তি, আহা কি যে তৃপ্তি!
খুলনা গেজেট /এনএম