সাতক্ষীরায় আসামীর নাম ও বাবার নাম ভিন্ন হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী হিসাবে কারাগারে রয়েছেন ক্যান্সার আক্রান্ত এক কলেজ শিক্ষক। গত ৯ মে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে সদর উপজেলার কুশখালী এলাকা থেকে র্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে কলারোয়া থানায় সোপার্দ করে। গ্রেপ্তারের পরদিন ১০ মে বুধবার আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতের নাম মোঃ মালেকুজ্জামান (৩৮)। তিনি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাঁছি গ্রামের আব্দুল মাজেদ সরদারের ছেলে ও সাতক্ষীরা সদরের ভালুকা চাঁদপুর ডিগ্রী কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক।
গ্রেপ্তারের গত ১০ মে বুধবার তাকে সাতক্ষীরার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর কাঠগোড়ায় উপস্থাপন করা হলে শিক্ষক মালেকুজ্জামান এর বক্তব্য ও উপস্থাপিত কাগজপত্র দেখে আগামি ২১ মে এর মধ্যে পুলিশ সুপারের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট সাতক্ষীরার কলারোয়া থানা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় কলারোয়া গ্রামের যুদ্ধকালিন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন বাদি হয়ে কেঁড়াগাছি গ্রামের বাবর আলীর ছেলে আব্দুল মালেকসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা (জিআর-২৫৯/১৪ কলাঃ) দায়ের করেন। এ মামলায় আব্দুল মালেক ২৭ নং আসামী। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা কলারোয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক শেখ সফিকুর রহমান ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল এজাহারে নাম ও ঠিকানা বর্ণিত আব্দুল মালেককে ২১ নং আসামী করে মোট ৫০ জনের নামে আদালতে ৬৯, ৬৯(ক) ও ৭৩ নং পৃৃথক তিনটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এদিকে মারপিটের মামলায় (টিআর-১৫১/১৫) মুখ্য বিচারিক হাকিম হুমায়ুন কবীর ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আসামী আব্দুল মালেককে চার বছর সশ্রম কারাদন্ড ও পৃথক ধারায় পৃথক পাঁচ হাজার টাকা করে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে পৃথক এক মাস করে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডাদেশ দেন। গত ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল অস্ত্র আইন ও বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের পৃথক দুটি মামলায় (এসটিসি-২০৭/১৫ ও এসটিসি-২০৮/১৫) আব্দুল মালেকসহ ৪৪ জনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদন্ড ও চারজনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। তিনটি মামলায় আসামী আব্দুল মালেক কখনো গ্রেপ্তার হননি বা আদালতে হাজির হননি।
সাতক্ষীরার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর কাঠগোড়ায় গত ১০ মে বুধবার দুপুরে হাজির করানোর পর বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেঁড়াগাছি গ্রামের আব্দুল মাজেদ সরদারের ছেলে মালেকুজ্জামান বলেন, তিনি ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভালুকা চাঁদপুর কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৮ সালে তিনি এমপিওভুক্ত হন। ২০০২ সালের প্রথম দিকে থেকে তিনি খুলনায় বসবাস শুরু করেন। এমনকি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ঠিকানা খুলনায় পরিবর্তন করে সেখানে ভোটার তালিকায় নাম তোলেন। খুলনা থেকে তিনি নিয়মিত কলেজ করতেন। কয়েক বছর আগে তিনি ভারতের ভেলোরে যেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানতে পেরে অপারেশন করান। দেড় থেকে দুই মাস অন্তর তাকে ভেলোরে মেডিকেল চেকআপে যেতে হয়।
মালেকুজ্জামান আরও বলেন, গত ৯ মে সকালে তিনি ভাগ্নে তামিমের মটর সাইকেলে কেঁড়াগাছি আসেন। সেখানে দাদার কবর জিয়ারত শেষে কুশখালিতে বোন ফতেমার বাড়িতে যান। বোনের বাড়ির পাশে অবস্থান করাকালীন ৯ মে রাত সাড়ে ৮টার দিকে র্যাব সদস্য পরিচয়ে সাদা পোশাকে তাকে ও তার ভাগ্নে তামিমকে আটক করে প্রথম ছকুড়ো গ্রামের একটি ইটভাটায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাদেরকে র্যাব এর গাড়িতে করে সাতক্ষীরা র্যাব ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি তার প্রকৃত নাম, বাবার নাম ও পেশাগত পরিচয় দেন। এসময় তিনি আব্দুল মাজেদ সরদারের ছেলে মালেকুজ্জামান এবং গাড়ি বহরে হামলা মামলার আসামী বাবর আলীর ছেলে আব্দুল মালেক নন বলে জানান। এরপর রাত ১২টার দিকে তামিমকে র্যাব সদসরা কদমতলা বাজারে পৌঁছে দেন। রাত দুটোর পর তাকে কলারোয়া থানায় সোপর্দ করা হয়। এ সময় আদালতে উপস্থিত থাকা কলারোয়ার জনৈক অ্যাড. জালালউদ্দিন মালেকুজ্জামানের পক্ষে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, কলেজের যোগদানপত্র ও ইউপি চেয়ারম্যানের দেওয়া একটি প্রত্যয়নপত্রসহ বিভিন্ন প্রমাণাদির কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করেন।
এদিকে গত ১০ মে তারিখ দুপুর ১২টার দিকে সাতক্ষীরার কর্মরত সাংবাদিকদের মেইলে র্যাব-৬ এর সাতক্ষীরা অফিসের ৬৪০০/১০/সিপিসি-১/২৭ নং স্মারকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কুশখালি থেকে আব্দুল মালেক ওরফে মালেকুজ্জামানকে (৩৭) শেখ হাসিনার গাড়ি বহরের হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী হিসেবে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাতে আব্দুল মালেক ওরফে মালেকুজ্জামানের গ্রাম ও বাবার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
সাতক্ষীরা আদালতের গারদখানার রেজিষ্টারে ১০ মে কলারোয়া থানার জিআর- ২০৯/১৫ এবং এসটিসি-২০৮/১৫ নং মামলার আসামী হিসেবে আব্দুল মালেক (৩৮), পিতা- বাবর আলী, গ্রাম কেঁড়াগাছি, থানা কলারোয়া হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
কলারোয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে যথাযথ তদন্ত করে আদালতে যথাসময়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
সাতক্ষীরা স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৩ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, মালেকুজ্জমান আদালতে কাগজপত্রাদিসহ নিজেকে বাবর আলীর ছেলে আব্দুল মালেক নন ও ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন মর্মে দাবি করেন। জনৈক অ্যাড. জালালউদ্দিন ওই বক্তব্য সমর্থন করায় বিষয়টি নিয়ে ২১ মে তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের মাধ্যমে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারক বিশ্বনাথ মন্ডল। কারাগারে থাকা আসামী মালেকুজ্জামান এর উপস্থিতিতে ওই দিন শুনানি হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম