চাকা ফেটে যাওয়ায় ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহনের বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। বাসের সামনের বাম পাশের টায়ার ফাটা ছিল। যাত্রীর আসন সংখ্যায় ৪০ জনের অনুমোদন থাকলেও পরিবর্তন করে তিন সিট বাড়ানো হয়েছিল। সড়কের দুই পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকলে গাড়ি নিচে পড়ত না এবং প্রাণহানি কম হতো। এমন নানা তথ্য ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে বুয়েটের এক তদন্ত প্রতিবেদনে।
রবিবার (১৬ এপ্রিল) বুয়েট কাউন্সিল ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্র। তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক। গবেষণা দলে ছিলেন ড. আরমানা সাবিহা হক, শাহনেওয়াজ রাব্বি, ড. সোহেল মাহমুদ, নাজমুল হক, আসিফ রায়হান, মাহবুব তালুকদার ও ইমরান উদ্দিন।
গত ১৯ মার্চ সকাল ৭টা ৩৮ মিনিটে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস ছিটকে পড়লে ঘটনাস্থলে ১৪ জন নিহত হন। পরে আরও পাঁচজন মারা যান। তা ছাড়া এ দুর্ঘটনায় আহত হন ২৬ জন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাসটি রাস্তা থেকে ছিটকে কালভার্টের উইং ওয়ালে ধাক্কা খায়। রাস্তার ওপর টায়ারের স্কিড মার্কের অনুপস্থিতি ইঙ্গিত করে যে, দুর্ঘটনাটি আকস্মিকভাবে হয়েছিল, যা টায়ার ফেটে যাওয়ার কারণে হতে পারে। ব্রেকের ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি। চালকের ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী, তার যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ ছিল। তাই চালকের ক্লান্তি এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। স্পিড ট্র্যাকিং ডেটার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, চালক অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাননি। এ অবস্থায়, টায়ার ফেটে যাওয়া দুর্ঘটনার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাসের অভ্যন্তরীণ ও বহির্ভাগ ভালো এবং ট্র্যাকিং ডিভাইস ছিল। গাড়িটি নতুন হলেও টায়ার মানসম্মত নয়, সামনের বাম পাশের টায়ারটি ফাটা ছিল। যাত্রীর আসন সংখ্যায় ৪০ জনের অনুমোদন থাকলেও অতিরিক্ত পরিবর্তন করে তিন সিট বাড়ানো হয়। বহু প্রাণহানির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি কালভার্টের ঠিক আগে বাসটির পথচ্যুতি ঘটে; শেষ পর্যন্ত কালভার্টের কংক্রিটের উইং ওয়ালের ওপরের প্রান্তে ধাক্কা খায়। ফলে বাসটির সামনের অংশ ভেঙে যায় এবং ভেতরের দিকে চেপে যায়। ড্রাইভার, সুপারভাইজার, হেলপার এবং সামনের সিটের যাত্রীদের সামনে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা না থাকায়, এবং যেহেতু বাসটি ভেতরের দিকে চেপে গিয়েছিল, ১৪ জনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়, এবং অন্য অনেকে গুরুতর আহত হন।
রাস্তা থেকে কোনো গাড়ি যেন ছিটকে না পড়ে এবং কোনো বিপজ্জনক বস্তু বা কাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা না খায় সে জন্যে রাস্তার ওই অংশে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী (ব্যারিয়ার বা গার্ড রেইল) ছিল না। যদি থাকত তবে বাসটি রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ত না এবং কালভার্টের সঙ্গে ধাক্কাও এড়ানো যেত। সেক্ষেত্রে এত প্রাণহানি না-ও হতে পারত। উচ্চমাত্রার বিপদের ঝুঁকি বিবেচনা করে রাস্তার ঢালের উচ্চতা যদি ছয় ফুটের বেশি হয় তবে আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী সড়কের দুইপাশে গার্ড রেইল স্থাপন করা হয়। তদন্ত দলের প্রধান ড. শামসুল হক বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে গতির জন্য দুর্ঘটনা হয় না। দুর্ঘটনা হয় বিশৃঙ্খলার জন্য।’ হাজার হাজার কোটি টাকার সড়কে আর সামান্য বিনিয়োগ করলে দুই পাশে অবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেষ্টনী রাখা যায়। এমন নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকলে গাড়ি নিচে পড়ত না এবং প্রাণহানি কম হতো বলে তিনি অনুমান করেন।
এক্সপ্রেসওয়ের ত্রুটি সম্পর্কে ড. শামসুল বলেন, ক্লিয়ার জোন বা মৃদু ঢাল না থাকা, রাস্তার অন্য প্রান্তের মতো দুর্ঘটনার প্রান্তে টানা গার্ড রেইল না থাকা, রাস্তা ও হার্ড শোল্ডারের মধ্যে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান এবং ব্রিজের প্রান্ত ও রাস্তার মধ্যে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে : সড়কের বিশৃঙ্খলা দূর করার উপায় হিসেবে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ড. শামসুল হক। তিনি বলেছেন, ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসগুলোর রুট পুনর্নির্ধারণ করা দরকার। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত একটি পরিবহনের আওতায় সেবা দেওয়া উচিত। মাওয়া থেকে বিভিন্ন স্থানের সেবায় আন্তঃজেলা বাস পরিচালনা করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বললেও আমাদের চিন্তাভাবনা প্রাগৈতিহাসিক মন্তব্য করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, রাস্তা উঁচু করা হচ্ছে, কিন্তু রেলিং নেই। শুধু ব্রিজে রেলিং দেওয়া হচ্ছে। টানা রেলিং দিতে হবে। আমাদের দেশে বিদেশ থেকে আসা নির্মাণ পরমর্শকরাও নিম্নমানের; দায়সারা কাজ করে যায়। এখানে শুধু চালকের দোষ না। উন্নত দেশে ব্যারিয়ার না দিলে শাস্তি হয়। কিন্তু আমরা শুধু চালক চালক করছি। অন্য কোথাও মনোযোগ নেই। তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ নিষেধ থাকলেও বিভিন্ন স্থানে থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, এলোমেলো পথচারী পারাপার ও ঢিলেঢালা মনিটরিং সিস্টেমও দায়ী।
প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী, মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান, ইমাদ পরিবহনের ব্যস্থাপক ওয়াহিদুল ইসলাম, তদন্ত দলের সদস্য, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, বুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছিলেন। বুয়েটের এই গবেষণাকেন্দ্রটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন তদন্ত-গবেষণা ও তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে থাকে।
খুলনা গেজেট/কেডি