জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে গিয়ে গত ১০ বছরে বাঘের আক্রমনে প্রাণ হারিয়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলের সহাস্রাধিক বনজীবী মানুষ। সম্প্রতি সময়ে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানোর সংখ্যা কমলেও একসময় প্রায় সুন্দরবনে এমন খবর পাওয়া যেত। বাঘের হামলায় প্রাণ হারানোকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে মেনে নেয় না সাধারণ মানুষ। ফলে নিহতের স্ত্রীদেরকে বাঘ বিধাব নারী অপবাদ নিয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকতে হয় সমাজে।
পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন সুন্দরবনের বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় সাতক্ষীরার উপকূলের লক্ষাধিক মানুষের। প্রতি বছর মৌসুমে বন বিভাগ থেকে বৈধ পাশ নিয়ে গোলপাতা কাটা, মধু আহরণ, নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরাসহ বিভিন্ন কাজে যেত বনজীবিরা। অনেকে পাশ ছাড়াও অবৈধভাবে সুন্দরবনে গিয়ে মধু আহরণসহ নদীতে মাছ ধরার কাজ করতো। ফলে একসময় বনজীবি এসব মানুষের উপর বাঘের আক্রমনও ছিল অনেক বেশি। কয়েক বছর আগেও প্রায়ই বাঘের আক্রমনে জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। বাঘের আক্রমনে দাদা, বাবা ও পরে ছেলেরও মৃত্যু হয়েছে এমন খবর ও পাওয়া যেত। সম্প্রতি সময়ে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমনে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমেছে। তবে ভাল নেই উপকূলে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্ত্রী বাঘ বিধবা নারীরা। অভাব অনাটন আর সমাজের নানা বঞ্চনা সহ্য করে বেঁেচ থাকতে হচ্ছে তাদের।
খোঁজ নিয়ে যানা যায়, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকুলীয় এলাকয় এক হাজারেরও বেশী বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। অভাব অনাটন আর সামাজিক বঞ্চনা নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত প্রায় ১০০০ থেকে ১১০০ বাঘ বিধবা নারী। এসব বাঘ বিধবা নারীরা সাংসারিক কষ্টের পাশাপাশি মানুষিক ভাবে নিঘৃত হচ্ছেন সমাজ থেকে। প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে তাদের অপায়া, অলক্ষী, ডাইনি ইত্যাদি নামে।
সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা নারী রাশিদা বেগম জানান, ৮/১০ বছর আগে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে যেয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয় স্বামী আলম গাজী। স্বামীর রেখে যাওয়া শুধু কয়েক শতক জমির ভিটাবাড়িতে কোনো রকম মাথা গোজার মত করে ৪টি সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে বসবাস করেন।
রাশিদা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে এদিকে যেমন আর্থিক অনাটন আর অন্যদিকে সমাজের নানা ধরনের বঞ্চনা এবং কুসংস্কার নিয়ে অত্যন্ত মানবেতের জীবনযাপন করছি। শুধু তাই নয় স্বামীকে বাঘে ধরার খবর পাওয়ার পর থেকে তার পরিবারের লোকজনের মুখ থেকে আমাকে এখনো অপয়া অলক্ষি শুনতে হয়। তবে তিনি এখনও পর্যন্ত সরকারি কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি বলে জানান।
একই গ্রামের বাঘ বিধবা নারী মুর্শিদা বেগম জানান, গত দুই বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের হাতে নিহত হয় স্বামী রেজাউল ইসলাম। ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ক্ষেত মজুরীর কাজ করে জীবনযাপন করছেন তিনি। মুর্শিদা জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর যে মানুষিক কষ্ট পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন সমাজের বঞ্চনা থেকে। স্বামীর আত্বীয়স্বজনের বাড়ি গেলে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কথাও বলতে চায় না। কারন আমারই কারণে বাঘে ধরেছে স্বামী রেজাউলকে। এরকম নানা ধরনের কুসংস্কার ও সামাজিক বঞ্চনা মাথায় নিয়ে দিন কাটছে আমার। তবে শুনেছি বৈধ পাশধারী কোনো বনজীবি বাঘের আক্রমনে নিহত হলে সরকার ক্ষতিপুরন দিচ্ছেন। কিন্ত আমি এখনো পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপুরন পাইনি।
রাশিদা বেগম আর মুর্শিদা বেগমের মত একই মানুষিক কষ্টের বর্ননা দিলেন, সুন্দরবন লাগোয়া খলশিবুনিয়া গ্রাামের বাঘ বিধবা নারী রহিমা বেগম, পার্শ্বেমারী গ্রামের সুখজান বিবি, গাবুরা গ্রামের খাদিজা খাতুন ও ৯ নং সোরা গ্রামের আনোয়ারা বেগম। এসব বঞ্চনার শিকার বাঘ বিধবা নারীরা পুনর্বাসনের সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাদের মত সাতক্ষীরার উপকুলীয় অঞ্চলের শ্যামনগর উপজেলাতেই ৫ শতাধিক বাঘ বিধবা নারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের এ্যাভোকেসি অফিসার পরিতোষ কুমার বৈদ্য জানান, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা শ্যামনগর ও কয়রা এলাকার বাঘ বিধবাদের নিয়ে কাজ করছেন তার সংস্থাটি। লিডার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও পার্শ্ববর্তী কয়রা উপজেলাইে ১ হাজার ১০০ জন বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জন বাঘ বিধবা নারীদের সহায়তার জন্য কাজ করছে লিডার্স। এরমধ্যে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ও গাবুরা ১২০ জন এবং কয়রার বেতকাশি ইউনিয়নের ১৮০ জন।
তিনি আরও বলেন, জলাবায়ু পরিবর্তনে ঝকিপূর্ণ জনগনের জীবন জীবিকা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ২০১২ এর অধিনে বাঘ বিধবাদের বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করা হয়। জার্মানির একটি দাতা সংস্থার সাথে স্থানীয় এনজিও লিডার্স প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ করছেন। আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি চলবে বলে জানান তিনি।
পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম.কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী জানান, বৈধ পাশ নিয়ে সুন্দরবনে যদি কোনো মৌয়াল, জেলে বা বাওয়ালী বাঘের আক্রামনে নিহত হন তাহলে সরকার তাকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। একই সাথে কেউ আহত হলে তাকেও ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। বন্যপ্রাণীদ্বারা আক্রান্ত বিধিমালা ২০২১ এর অধিনে এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন সরকার। তবে এর আগে সরকারী সাহায্যের পরিমাণ ছিল কম। সরকারি আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যে সমস্ত বাঘ বিধবা নারী রয়েছে তাদের বিনা মুল্যে পাশ দেয়া হচ্ছে। তারা যেন নদীতে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে অন্তত কিছু উপার্জন করে সংসার নির্বাহ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ উপায়ে যারা সুন্দরবনে মধু আহরণ বা মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয় তারা সরকারের এই সহায়তা পাবে না। আর যারা অবৈধ ভাবে বনে প্রবেশ করে বন্যপ্রাণীদের হাতে নিহত হয় সরকারী ভাবে সে সব মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বুড়িগোয়ালী রেঞ্জের অধিনে সরকারী ভাবে বাঘের আক্রমণে নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান তিনি দিতে পারেননি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক মোঃ আনিসুর রহিম জানান, এসব বাঘ বিধবা নারীদের সরকারী সহায়তার মাধ্যমে পুনর্বাসন করতে হবে। তাছাড়া তাদের সাথে ভালো আচরন করা সমাজের সকল স্থরের মানুষের উচিৎ। তিনি বলেন, একে তারা স্বামী হারা তার পর যদি তারা সামাজিক ভাবে বঞ্চনার শিকার হন তাহলে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।
উপকূলীয় এলাকায় কিছু এনজিও সংস্থাও বাঘ বিধবাদের নিয়ে কাজ করছেন উল্লেখ করে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার যে সমস্ত অসহায় বাঘ বিধবা নারী রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।