দিনটি ২০০৯ সালের ২৫ মে। দুপুর বেলা। আকাশ কালো করে মেঘ নামে। সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। বেলা বাড়তে থাকে, বৃষ্টির ঝাঁঝও বাড়ে। একসময় সবকিছু কালো করে চারিদিক অন্ধকার করে ফেলে। আগে থেকেই আলো-আঁধারির লুকোচুরি চলছিল। এখন যেন মেঘদল উড়তে উড়তে মাথার উপর নেমে এসেছে। ঢাকি’র তখন অন্যরূপ। পানি ফুলে উঠেছে। গজরাচ্ছে। কি ভয়ানক আওয়াজ। মন্ডলদের বাড়ির কাছে যেখানে বাঁধ কেটে নোনা পানি তোলা হয়েছিল, সেখানেই পানির প্রবল চাপ। সেখানেই ভাঙ্গন ধরে। বাঁধতো কাটা-ছেঁড়া করতে করতে আর নেই কিছু। বাঁধ এখন দুর্বল। বাঁধের বাইরে, নদীর পাড়ে আর কোন মাটি নেই, এতোদিনে তা নদীর পেটে গেছে। এখন নদীর জোয়ার এসে বাঁধের পারে আছড়ে পড়ে। সেই জোয়ারের পানি এই ঝড়ের প্রভাবে আরও ফুলে-ফেঁপে কয়েকগুণ প্রবল হয়েছে। বাঁধের কতো জায়গায় যে ভাঙ্গবে, তা কে জানে।
শিবু আর ভাবতে পারে না। নোনা ঠেকাতে বাঁধ, সেই বাঁধ কেটে আবার নোনা পানি তোলা, তাতে চিংড়ি চাষ। যাতে কিছু মানুষের টাকা হলেও কৃষি পরিবারগুলোর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আর এখন নিত্য ঝড়-ঝঞ্জা। দুই বছর আগে এই রকম একটি ঝড় আঘাত হানে। তার নাম ছিল সিডর। তাতে খুব বেশী ক্ষতি হয়নি, তবুও কয়েক জায়গা দিয়ে জল ঢুকে গ্রাম-বিল তলিয়ে ছিল। এবারের ঝড়ের নাম আইলা। বেতারে বারবার সাবধান হতে বলছে। ঝড়ের আঘাত না-কি খুব তীব্র হবে। এবারের ঝড়টাও নাকি সুন্দরবনের এই কোণা দিয়ে আসবে। আগেরবার সুন্দরবনের পূব-কোণায় আঘাত হানে। বলেশ^র ফুলে উঠে শত শত মানুষ মারা যায়। এবারে যে কি হবে! বাঁধের ভাঙ্গন থেকে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকছে। দেখতে দেখতে পানিতে থৈ থৈ করতে থাকে চারিদিক।
বৃষ্টির জোরও বাড়ছে। সাথে প্রবল বাতাস। বাতাসে সবকিছু যেন উড়িয়ে নেবে। গ্রামের মানুষগুলো আর্তনাদ শুরু করেছে। চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। চেঁচামেচি। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দের মাঝে মানুষের সেই আর্তনাদ-চেঁচামেচি চাপা পড়ে যায়। মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে, বড় বিপদ আসছে। ঘর-বাড়িতে হয়তো থাকা যাবে না। মুহূর্তের মধ্যে, বাতাস ও বৃষ্টি বাড়তে থাকে। ভরদুপুর বেলাতেও মনে হচ্ছে গভীর রাতের আঁধার। গ্রামের মানুষগুলো ঘর থেকে বেরুতে শুরু করেছে। কিন্তু কোথায় যাবে? ওই বাঁধই ভরসা। গ্রামের মধ্যে বাঁধইতো উঁচু। আর কারও যদি দালান বাড়ি থাকে। দুই তলা দালান বাড়ি না হলে লাভ নেই। ম-লদের একতলা দালানটাতো প্রায় ভাঙ্গনের মুখে। স্কুল ঘরটাও ভালো না। ফলে বাঁধের যে জায়গা ভেঙ্গে যায়নি, সেখানেই ঠাঁই নেওয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই। সবারই লক্ষ্য নদীপাড়ের ওই অক্ষত বাঁধের জায়গা।
শিবপদ আর বসে থাকতে পারে না। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। বউকে ডেকে বলে, ‘অনিতা, আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুনি ঘরেত্তে বেরোতি হবে। তা না হলি যে সক্কুলি ভাইসে যাবো।’
অনিতাও সাড়া দেয়। ‘হুম, তাই করতি হবে।’ হাতের কাছে সে যায় পায়, তাই জড়ো করতে থাকে। ধমক দিয়ে বলে ওঠে শিবু, ‘ওসব রাহো। আগে মাইয়ে দুটোরে নিয়ে হাঁটো। বাঁইচে থাকলি জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। চলো।’ তাই বলে সে পাঁচ বছরের শিশু মিঠুকে কোলে তুলে নেয়। বছর দশেকের হাসি অনিতার কাছেই ছিল। সে বাবা-মাকে অনুসরণ করে।
মিঠুকে নিয়ে শিবু আগে আগে হাঁটতে শুরু করে। অনিতা হাসিকে এক হাতে ধরেছে। ওরা সকলেই গা-ঘেঁষেই চলেছে। ওরা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে তাদের উঠোনে দাঁড়ায়, তখুনি প্রায় বুক সমান পানি টইটম্বুর করছে। পানি বাড়ছে। ঘরের বারান্দায় পানি উেেঠছে। শিবু বলে, ‘সীমানাটুকু পার হয়েই রাস্তায় উঠতি হবে। ওই রাস্তায় এখনও পানি ওঠেনি। ওই দেখ, গ্রামের মানুষ সব ভাইঙ্গে পড়িছে। তাড়াতাড়ি চলো। এইখান থেকে বেশ খানিকটা গেলেই তবে আমরা বাঁধের উপর যাতি পারবো।’
কোথাও গলা পানি, কোথাও বুক সমান পানি ভেঙ্গে তারা এগুতে থাকে। মিঠুকে মাথায় তুলে নিয়েছে শিবু। পানির প্রবল চাপে হাসি যেন আর এগুতে পারছে না। অনিতা তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তারা জোরে জোরে পানি ঠেলে, সাঁতার কেটে, কখনও জোরে জোরে হেঁটে এগুনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির ঝাপটায় মাঝে-মধ্যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর প্লাবনের পানির তীব্র স্রোতে। মানুষগুলো বড্ড কাহিল হয়ে পড়ে। এভাবেই ঝড়-জলের সাথে ঘন্টাখানেক লড়াই করে তারা বাঁধের উপর আসে। তখনও গ্রামের সব মানুষগুলো এসে পৌঁছাতে পারেনি। কেউ কেউ এসেছে, কেউ আসছে। কেউ প্রিয়জনকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে ডাকছে। শিবুর কানে আসে, নগেনকে তার মা ডাকছে। ওরে নগেন তুই কোই গেলিরে! নগেন, ও-হ ন- গে—-ন।
বৃষ্টি-ঝড়ের দাপট সন্ধ্যার দিকে কমে আসে। চারিদিকে আঁধার নামে। সেই আঁধারে যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। বাঁধ ভাঙ্গার জায়গা দিয়ে তখনও গ্রামের মধ্যে, বিলে পানি ঢুকছে। তারই কল-কল শব্দ, আর বেশীরভাগ মানুষের হা-হুতাশ, কখনও কখনও কারও নাম ধরে ডাকতে থাকার শব্দে পুরো এলাকার নৈ:শব্দ খান খান করে দিচ্ছে।
দিনটা চলে গেছে। কেউ যেন খাওয়ার কথা মুখেই আনেনি। রাতও কেটেছে নানান শঙ্কায়। যদিও ভারী বৃষ্টি আর নামেনি, তবুও বাতাস ছিল, ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টির ফোঁটা ছিল। শিশু ছেলে-মেয়েগুলো তাদের মা-বাবার কোলে-আঁচলের ছায়ায় ঘুমিয়েছে। বয়সীরাও ঝিমিয়েছে, তবে ক্ষণে ক্ষণেই মাথা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। জোয়ারের পানির শব্দ, গাছ উপড়ে পড়ার শব্দ, নদীর জলে বড় গাছের পাতাদের শব্দ, ভেজা পাখির করুণ আর্তনাদ, পোকাদের চলাচল-ডাকাডাকির শব্দ, গুবড়ে পোকার চলাচল, কারও কারও শরীরের সাথে পরনের কাপড়গুলো ভিজে লেপ্ট যাওয়া – এরমধ্যে কিভাবে যে রাতটি পার হয়ে যায়। চারদিক ফর্সা হতে শুরু করেছে। পাখিরা ডাকছে। ওই দূরের কোন এক মসজিদ হতে শোনা যাচ্ছে আজানের সুমধুর ধ্বনি। শিশু ছেলে-মেয়েগুলো নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। তাদের খিদে পেয়েছে। খাবার চায়। কিন্তু কোথায় খাবার! খাওয়ার পানি কোথায়! এই অঞ্চলের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে বড় পুকুরের পানি আর বৃষ্টির পানি মাটির মাইঠের মধ্যে ধরে রেখে পান করে। বৃষ্টির পানিতে বড়জোর তিন-চার মাস চলে। বাকি সময় পুকুরের পানি-ই ভরসা। সে-সবতো ঝড়-জলের পানিতে একাকার। চারিদিকে, যতদূর চোখ যায়, পানি আর পানি। মাঝে-মধ্যে বাড়ি-ঘরগুলো যেন পানির মধ্যে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
কিছু পাওয়ার আশায় শিবু বুক সমান পানি ঠেলে, কোথাও সাঁতরে বাড়ি যায়। ঘরের মধ্যে তখন কোমর সমান পানি। সেখান থেকেই খুঁজে খুঁজে একটি বোয়েমে কিছু চিড়ে-মুড়ি পায়, আর একটিতে পায় বিষ্কুট। তাই নিয়ে সে ফেরে। কিন্তু খাওয়ার পানি! কোথাও পাবে তা! সকলেরই পানি চাই। এলাকার কিছু যুবক নদী পাড়ি দিয়ে অপর পার হতে নলকূপের পানি নিয়ে এসে বিলি করতে শুরু করেছে। দুই-একজন সাংবাদিকও আসে উপজেলা সদর হতে। পরে জেলা শহর হতে অনেক সাংবাদিক আসে। ছবি তোলে। ঘটনা জানতে চায়। কি আর বলবে। শিবু’র এসব কিছু ভালো লাগে না। আপন মনেই বলে চলে, কথায় আছে না, ঘরে আগুন লাগিছে তাতে আলু পোড়াতি আছে পাশের লোক! ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে শত শত মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়েছে, খাবার পানিটুকু নেই, শিশুদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো কিছু নেই। সাংবাদিকরা ছুটাছুটি করছে! প্রয়োজন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া। তা আর কে করে!
দু’দিন এভাবেই কেটে যায়। নৌকা-ট্রলারে করে দূর থেকে মানুষেরা আসতে শুরু করে। শুকনো খাবার, পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, একান্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র বিলি করতে শুরু করেছে। ছোট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে উদাস হয়ে বসেছিল শিবু। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। চিংড়ি ঘের শুরু হলে সেই ছোটবেলায় সে যেমন পানিতে গোটা এলাকাটি ভেসে যেতে দেখেছিল, এও তেমনি। তবে সেবারে জোর করে মানুষ বাঁধ কেটে জোয়ারের পানি প্রবেশ করিয়েছিল; আর এবারে প্রকৃতি মানুষের সেই বাঁধের কাটা অংশ ভেঙ্গে নিয়ে পুরো গ্রাম ভাসিয়ে নিয়েছে। যদিও এখন আর কেউ তেমনভাবে চিংড়ি চাষ করে না। শহুরে মানুগুলো শুরু করার একটি পর্যায়ে এসে এলাকার মানুষেরাই চিংড়ি ঘের করতো। তাতে ছোট ছোট অনেক ঘের হয়। কিন্তু ফলন কমে যায়। খরচ বাড়ে। তারপর বছর-খানেক আগেতো মানুষ চাল কিনেই খেতে পারেনি। মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায় – ধান না ফলানোর কি জ¦ালা! সেই থেকে নোনা পানির চিংড়িকে সক্কুলি না বলতে শুরু করে। কিন্তু চিংড়ি চাষের সেই ক্ষত রয়ে গেছে। বাঁধগুলো এক্কেবারে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। কাটতে কাটতে বাঁধের আর শক্তি নেই। তার উপর বাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসানো। আবার বাঁধের বাইরে নদীর কুলের মাটিও নেই, ফলে জোয়ারের তোড় এসে সরাসরি বাঁধের উপর আছড়ে পড়ে। এইভাবেই ম-ল বাড়ির পাশের বাঁধের কাটা জায়গা ভেঙ্গে নদীর পানি হু হু করে ঢুকে গ্রাম ভাসিয়ে নিল।
অনিতা এসেই শিবুকে বলতে শুরু করে। এভাবে বসে থাকলিতো চলবে নানে। বাড়ি-ঘরে কবে যাওয়া যাবে, তারতো ঠিক নেই। চারদিকে শুধু জল আর জল। এই বাঁধের উপর রাত কাটানোর জন্যি একটু ছাপড়া বানানোর চেষ্টা করো। অন্যরাওত দেখতিছি বাঁশ-খুটি জোগাড় করার চেষ্টা করতিছে। তুমিও যাও, দেহো, কিছু জোগাড় করতি পারো কি-না। তা না হলি বাঁধের উপর এই জায়গাটুহুও কিন্তু আর ধইরে রাহা যাবেনানে।
অনিতার কথায় শিবুর মাথায় চিন্তার উদয় হয়। তাইতো থাকার জন্যে কিছু একটা করতে হবে। মিঠুকে অনিতার কাছে দিয়ে সে পূবদিকে হাঁটতে শুরু করে।
মানুষের বাড়ি-ঘরের টিকে থাকা জিনিসপত্র দিয়েই বাঁধের ওপর সারি সারি ঝুপড়ি ঘর ওঠে। একটি গ্রামের সব মানুষ এখন বাঁধের উপর। ভাবা যায়, গৃহস্থ বাড়ির একটি-দুটি বা তিনটি ঘর সাধারণভাবে থাকবার ঘরটি দক্ষিণমুখো হয়; তার বিপরীত দিকে অথবা পশ্চিম দিকে আর একটি ঘর সেটি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রান্নাঘর; বেশী ঘর হলে চার দিকে চারটি ঘর। মধ্যিখানে উঠোন। একটু দূরে গরু-বাছুর-ছাগলের জন্য ঘর। যে বাড়িতে মানুষ বেশী, বা সম্পদশালী সেই বাড়ির বসবাসের ঘরগুলো ইটের, তা না হলে আটচালা, নিতান্ত গরীব পরিবারগুলোর দোচলা ঘর। অধিকাংশ ঘরের চালা সুন্দরবনের গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। এর নামই গোলপাতা, পাতা কিন্তু মোটেও গোলাকৃতি নয়; বরং নারিকেলের পাতার মতো। শুধুমাত্র আমন ধানের চাষ হতো যখন, তখন ধানের জাতগুলোর কা- অনেক বড় হতো। গাছগুলোর গোড়ার একটি নির্দিষ্ট অংশ কা- রেখে উপরে ধানের ছড়াসহ কেটে নেওয়া হতো। গোড়ার কা-টুকু যা রয়ে যেতো তাকে নাড়া বলতো। এই নাড়া দিয়েও অনেকে ঘরের ছাউনির কাজ চালাতো, আবার জ¦ালানি হিসেবেও ব্যবহার করতো। এখন সেসব অতীত। এখন উচ্চ ফলনশীল বা উফশী জাতের ধানের চাষ হয়। এর কা- ছোট। ফলন ভালো। আবার একাধিক জাত লবন সহনশীল। নোনা পানি টেনে এনে চিংড়ি চাষের ফলে যে মাটিতে নোনার পরিমাণ বাড়ানো হ’লো, সেই মাটিতে আবার নোনা সহনশীল ধান। আর এখন কথায় কথায় সুর উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন। এ কারণে নাকি ঝড়-ঝঞ্জা বাড়ছে। হয়তো ঠিক। তাই বলে নিজেরা যে নোনা টেনে আনা হলো, তার দায় কিভাবে এড়াবে! শিবু আপন মনে এসব ভাবে, আর হাসতে থাকে। সেই ঝড় এখন বাঁধের উপর মানুষকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর ক্ষমতাবানরা সবকিছুতে প্রকৃতির উপর দোষ দিতে শুরু করেছে। ক্ষমতাবানরা, চিংড়ি চাষীরা, তারা ভালো আছে; নিজেদের কোন দায় নেই!
শহর থেকে মানুষেরা আসছে, এলাকার রাজনীতিকেরাও আসছে, এলাকার সংসদ সদস্যও এসেছিল। তারা খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে; নিতান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীও দিচ্ছে। কিন্তু কতোদিন দেবে! আর কতোদিন এভাবে বাঁধের উপর থাকতে হবে, তাই বা কে জানে। যে বাড়ির মানুষগুলোর খাবারের এতো সংকট ছিল না, তারাও ত্রাণ সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শিবু’র কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, হাত বাড়িয়ে সহায়তাও নিতে পারে না, কেমন যেন মূক-বধির হয়ে যাচ্ছে সে। অনুভুতিগুলো কেমন যেন মরতে বসেছে। অনিতাই সহায়তাগুলো সংগ্রহ করে। সেই সংগৃহীত সামগ্রীগুলো যত্ন করে রাখে। মেয়ে দুটোকে খাবারতো তাকেই দিতে হয়। যদিও হাসি এখনও বুকের দুধের উপর নির্ভর করে। শিবু এদিক-ওদিক ঘোরে। শিবুকে দেখলেই যেন অনিতা রাগে জ¦লতে তাকে। খিটিমিটি করে। কখনওই ভালোভাবে কথা বলে না। শিবুও অবাক হয়, দিনদিন অনিতা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। শিবু’র উপর যেন তার বিরক্তি বাড়ছে। শিবু’র কোন কিছুই যেন অনিতা সইতে পারছে না।
মন্ডল বাড়ির পাশের বাঁধ-ভাঙ্গা জায়গার কাছে দাঁিড়য়ে সে জোয়ারের পানি প্রবেশ করা দেখছিল। ঢাকির পানি গজরাতে গজরাতে গ্রামের মধ্যে ঢুকছে। আর প্রবল তোড়ে বাঁধের ভাঙ্গন বড় হচ্ছে। ঝড়ের দিনে ভাঙ্গনের পরিমাণ ছিল বড়-জোর হাত পাঁচেক, এক সপ্তাহেই তা ত্রিশ হাতের মতো চওড়া হয়ে গিয়েছে। এখুনি যদি ওই ভাঙ্গন আটকানো না যায়, তাহলে আরও বড় হবে, মানুষের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদের আরও ক্ষতি হবে। একেবারেই পাশে ম-লদের বাড়ি। ওই বাড়িটি খুবই বিপদে আছে, ভাঙ্গন আরও কয়েকদিন থাকলে ম-ল বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ডুবে যাওয়া গ্রামের মানুষগুলোকে পথে বসিয়েছে, অনেককে ডুবিয়েই ছাড়বে। ভাঙ্গনকবলিত মানুষগুলো তাই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপি, পাউবো কর্মকর্তা প্রভৃতিদের কাছে যাচ্ছে, আকুতি জানাচ্ছে, ‘আমাদের বাঁধটি আটকে দেন।’ এলাকা বাঁচান। কর্মকর্তারা আসেন, নেতারা আসেন। কাজ করার কথা বলেন, কিন্তু তার উদ্যোগ দেখা যায় না। ঢাকি’র পানিতে এখন জালিয়াখালি গ্রামটি ডুবে আছে। বাঁধ না আটকানো গেলে পাশের গ্রামও ডুববে। মন্ডল বাড়িটি চলে যাবে ঢাকির পেটে।
সেদিন এলাকার এমপি এসেছিলেন। বাঁধের লোকজন তাকে প্রায় জাপটে ধরেছিল। বাঁধ বাঁধার কোন উদ্যোগ নেই কেন? সকলের মুখে এক কথা। কিন্তু তার জবাব দেন না। এদিক ওদিক পাশ কাটিয়ে চলে যান। আবার বলেন, সবকিছুতো নোনা পানির পেটে চলে গেছে। ধান ও অন্যান্য ফসলতো কিছু করা যাচ্ছে না। ফলে নোনা পানি ব্যবহার করে আবার দুই-এক বছর চিংড়ি চাষ করলে কেমন হয়। শোনো কথা! এই এমপি নির্বাচনের আগে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে এলাকায় নোনা পানির চিংড়ি চাষ, ঘের হবে না। এখন আবার এসেছেন, চিংড়ি চাষ করার পক্ষে কথা বলতে। জনমত প্রভাবিত করতে। দুটো বছর আগের খাদ্য সংকটকে বিবেচনায় নিয়ে এলাকার মানুষ আর চিংড়ি চাষ করতে চায়নি। নোনা পানির সাথে বসত করতে চায়নি। আইন সভার সদস্য হওয়ার জন্যে ভোট চাইতে তাই মানুষের মনোভাবকে সম্মাণ জানিয়েছল, বলেছিল, তিনি আর নোনা পানির চিংড়ি চাষ এই এলাকায় হতে দেবেন না। অথচ, কি আশ্চর্য, মানুষের আকুতি বাঁধ অবিলম্বে বাঁধা হোক; কিন্তু তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছেন না। এদিকে ম-ল বাড়ি ঢাকির পেটে গেছে। এই এলাকার অন্যতম ধনী, যার নিজের সত্তর বিঘা ধানের জমি। দুই ভাইয়ের দুটো পাকা বাড়ি। ছেলেদের জন্যে আরও ঘর। দুটো ধানের গোলা। তিন বিঘা জমির উপর বাড়িতে ছিল আশিটি নারকেল গাছ। বিবিধ ফলের গাছ। সব, স-ব চলে গেছে ঢাকির পেটে। অথচ বাঁধের ভাঙ্গন আটকানো গেলে এই সম্পদহানি হতো না।
সেদিন এমপি অবশ্য নিজের দায় এড়াতে হোক, আর এলাকাবাসীকে আশ^স্ত করার জন্যে হোক, বলেছিল -যে কোন কাজের ফাইল কিভাবে এগোয়, সিদ্ধান্ত কিভাবে গৃহীত হয়। যে কোন কাজের প্রস্তাবনা তৈরি করে অফিসের লোকেরা। তাৎক্ষণিকভাবে বাঁধ দেওয়ার মতো কোন অর্থ ওই অফিসের কাছে নেই। সরকারও তাদের অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেনি। তাই বাঁধের ভাঙ্গন বড় হচ্ছে। আর সময়টা বড্ড খারাপ। বর্ষাকাল। এ সময় নদীতে পানির চাপ বেশী থাকে। পানির চাপ থাকলে বাঁধ আটকানো কঠিন হয়। আবার এই মাটির আঠালোভাব কমে গেছে। পানি ঝুরঝুরে, ভঙ্গুর। এতে বাঁধ মেরামত বা ভাঙ্গন রোধ করা খুবই কষ্টের। তাই রিং বাঁধ দেওয়া হবে। কারা যেন হৈ হৈ করে ওঠে।
-রিং বাঁধ মানেতো ওই বাঁধের বাইরের জমি এক সময় নদীগর্ভে চলে যাবে।
-তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এর বিকল্পতো কিছু নেই। রিং বাঁধ হবে, তাতে মাটির কাজে এলাকাবাসী যোগ দিতে পারবে। এতে দিনমজুরি বাবদ হাতে নগদ টাকা আসবে। আয় হবে। এখনতো আয়ও নেই। (চলবে)