চলমান করোনাভাইরাস মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, আসন্ন খাদ্য সংকট এবং মাঙ্কিপক্স নিয়ে বিশ্ব ‘ভয়াবহ’ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস। আফ্রিকার বাইরে এক ডজনেরও বেশি দেশে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এই সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন তিনি।
সোমবার (২৩ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইসরায়েলে ৯০ জনেরও বেশি মানুষ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে জনসাধারণের জন্য এখনও ব্যাপক কোনো ঝুঁকি নেই বলেই বলা হচ্ছে।
বিবিসি বলছে, মাঙ্কিপক্স ভাইরাসটি মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা নেই এবং অসুস্থতা সাধারণত হালকা হয়।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মতে, ভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন।
বিশ্বে এর আগে মাঙ্কিপক্সের অল্প কিছু সংক্রমণ পাওয়া গেছে। যাদের শরীরে এটি পাওয়া গিয়েছিল তারা সবাই ভাইরাসটির প্রাকৃতিক আবাসভূমি যেসব দেশে সেখানে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো এমন সব মানুষের দেহে এটি পাওয়া গেছে যাদের সাথে পশ্চিম অথবা মধ্য আফ্রিকার কোনো যোগাযোগও নেই।
ফলে কিভাবে তারা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। আর এই বিষয়টিই প্রাদুর্ভাব বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ‘মাঙ্কিপক্স’ সংক্রমণ মোকাবিলায় ২১ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন বিধি জারি করেছে বেলজিয়াম। দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যারা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে, তাদের তিন সপ্তাহের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার যুক্তরাজ্যে মাঙ্কিপক্সের আরও সংক্রমণের তথ্য ঘোষণা করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে রোববার ডব্লিউইচওর বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেন, ‘অবশ্যই (করোনা) মহামারি আমাদের বিশ্বের একমাত্র সংকট নয়। যেমন বিশ্বজুড়ে আমাদের সহকর্মীরা ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ইবোলার প্রাদুর্ভাব, মাঙ্কিপক্স এবং অজানা কারণের হেপাটাইটিস এবং আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়ান আরব প্রজাতন্ত্র, ইউক্রেন এবং ইয়েমেনে জটিল মানবিক সংকটের বিষয়ে সরব রয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সৃষ্ট রোগ, খরা, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের এক ভয়ঙ্কর অবস্থার মুখোমুখি রয়েছি।’
এদিকে দেশে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম জারি করা হলেও বেলজিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন বলেছে, তাদের দেশে মাঙ্কিপক্সের বৃহত্তর প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি কম। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘মাঙ্কিপক্স’ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমনিতে আইসোলেশনের প্রয়োজন হয় না। তবে কোভিড সংক্রমণের পর এখন অনেকেরই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। তাই সতর্ক থাকা উচিত।
‘মাঙ্কিপক্স’ মূলত গুটিবসন্ত বা চিকেনপক্স গোত্রেরই রোগ। তবে, এটি গুটিবসন্তের থেকে কম মারাত্মক, মৃত্যুর হার ৪ শতাংশেরও নিচে। বেশিরভাগ রোগীই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে, এর আগে কখনও আফ্রিকার বাইরে মহামারি আকারে এই রোগ ছড়াতে দেখা যায়নি।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার পর রোববার এই রোগ শনাক্ত করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যেও। আফ্রিকার বাইরে ‘মাঙ্কিপক্সের’ এই অস্বাভাবিক বিস্তারই উদ্বেগ বাড়িয়েছে ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের।
অপরদিকে ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরের মানুষের জীবনও ধ্বংস করছেন। আর এই ধ্বংযজ্ঞের মাত্রা এত বেশি হতে যাচ্ছে, যা দেখে হয়তো তিনি অনুশোচনাও করতে পারেন। কোভিড-১৯, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জ্বালানির আকস্মিক সংকটে ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানছে এই যুদ্ধ।
ইউক্রেনের শস্য ও তেলবীজের রপ্তানির বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে এবং রাশিয়ার রপ্তানিও হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ববাজারে সরবরাহকৃত মোট ক্যালোরির প্রায় ১২ শতাংশ আসে এই দুই দেশ থেকে। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে গমের দাম ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া উদ্বেগজনক তাপপ্রবাহের কারণে ভারত গত ১৬ মে গমের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আরও ৬ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এই খাদ্যশস্যের।
জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ধারণা সামনে কী হতে পারে সে বিষয়ে সঠিক পূর্বানুমাণ করতে পারছে না। গত ১৮ মে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আগামী মাসগুলোতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যে প্রচণ্ড ঘাটতি দেখা দেওয়ার হুমকি তৈরি হয়েছে, যা বছরের পর বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে।
প্রধান প্রধান বিভিন্ন খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে পর্যাপ্ত খাবারের নিশ্চয়তা নেই এমন মানুষের সংখ্যা ইতিমধ্যে বিশ্বে ৪৪ কোটি থেকে বেড়ে ১৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। আরও প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। যদি যুদ্ধ চলতে থাকে এবং বিশ্ববাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সরবরাহ সীমিত হয়, তাহলে আরও কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারেন। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে, শিশুদের জীবন থমকে যাবে এবং মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে।