খুলনা, বাংলাদেশ | ৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
  ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট এসআইদের সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিত

প্রাইমারির গণ্ডি না পেরিয়েই মাসে আড়াই হাজার ফেসবুক আইডি হ্যাক!

গে‌জেট ডেস্ক

মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার বাসিন্দা লিটন ইসলাম (২৮)। প্রাইমারির গণ্ডি পেরোতে না পারলেও কম্পিউটার চালনায় তার দক্ষতা ছিল বেশ। অভাবের তাড়নায় একসময় ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করে। সেই কাজ করতে গিয়ে তার হাতেখড়ি হয় ফেসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্যাকিংয়ে দক্ষতা বাড়ে তার। একপর্যায়ে হ্যাকিংয়ের মাস্টার বনে যায় লিটন। তার দাবি সর্বশেষ এক মাসে সে আড়াই হাজার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে। এসব আইডি’র মধ্যে দেশি-বিদেশি আইডিসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ রয়েছেন।

শুধু আইডি হ্যাক করে থেমে থাকেনি, এসব আইডিতে থাকা নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও নিজের কব্জায় নিয়েছে। আর এসব ছবি-ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে কামিয়েছে লাখ লাখ টাকা। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি এই হ্যাকার মাস্টারের। এক ভুক্তভোগীর ফাঁদে পড়ে তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

লিটনকে গ্রেপ্তারের পর খোদ ডিবি কর্মকর্তাই অবাক হয়েছেন। এত অল্প সময়ে আড়াই হাজার আইডি কীভাবে হ্যাক করেছে। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও দেখেও তারা বিস্মিত। শত শত ছবি- ভিডিও তার নিয়ন্ত্রণে। মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করার মূল অস্ত্র ছিল এগুলো। তবে ব্ল্যাকমেইল করে মানুষের কাছ থেকে ঠিক কত টাকা সে কামিয়েছে তার হিসাব এখনো পাননি ডিবি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া আড়াই হাজার আইডি’র বাইরে আর কত আইডি হ্যাক করেছে তার হিসাব জানার চেষ্টা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রিমান্ডে এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে ডিবি বলছে, আইডি হ্যাক করে লিটন অনেক তরুণীর সর্বনাশ করেছে।

এর আগে কদমতলী থানার তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলায় আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে একটি সিপিইউ, দুটি মোবাইলফোন ও ১০টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। লিটনের মূল বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার নতুনপাড়া গ্রামে। সে ওই এলাকার আব্দুর রহিম ও আসমা বেগমের ছেলে। আশুলিয়ার এনায়েতপুর ডলফিন গেইট এলাকায় সে একাই থাকতো। ডিবি জানায়, লিটন লেখাপড়া করেছে মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। সে কম্পিউটারের কাজে পারদর্শী ছিল। ফটোশপের ভালো কাজ জানতো। একপর্যায়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করে। এই কাজ করতে গিয়ে তার মাথায় ফেসবুক আইডি হ্যাক করার চিন্তা আসে। তারপর থেকে শুরু করে আইডি হ্যাক।

ডিবি সাইবারের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লিটন প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে ফিশিং লিংক ক্রিয়েট করে। পরে ফিশিং লিংকটির সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ছবি/ভিডিও জুড়ে দিয়ে সেটি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করতো। এ ছাড়া তার টার্গেট করা যেকোনো নারী-পুরুষের ই-মেইল বা ফেসবুক মেসেঞ্জারের পাঠিয়ে দিতো। এসব ফিশিং লিংকে প্রবেশ করতে চাইলে ফেসবুকের আইডি-পাসওয়ার্ড লাগে। যারা আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রবেশ করতো সঙ্গে সঙ্গে তার আইডি হ্যাকার লিটনের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত। লিটন মানুষের আইডির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওই আইডির মেসেঞ্জারে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি-ভিডিও তার হেফাজতে নিয়ে যেত। একপর্যায়ে আইডির মালিককে ফোন করে তার আইডি হ্যাকের বিষয়টি জানাতো। সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে টাকা দাবি করতো। কেউ টাকা দিতে না চাইলে তার ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করার ভয়ভীতি দেখাতো। আবার অনেকের আইডি থেকে রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট ও জঙ্গি বানানোর হুমকি দিতো।

ডিবি সূত্র বলছে, ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন (৫০) আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, ২৭শে ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার সময় অলিউল্লাহ কাজী নামের অপরিচিত আইডির মেসেঞ্জার থেকে তার মেসেঞ্জারে ফিশিং লিংক পাঠায়। তিনি ওই লিংকে প্রবেশ করলে রিডাইরেক্ট করে অন্য ওয়েবপেইজে নিয়ে যায়। এটি দেখতে হুবহু ফেসবুক- এর মতো। তিনি ওই ওয়েব পেইজে তার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করার চেষ্টা করা মাত্রই আইডি চলে যায় হ্যাকারের নিয়ন্ত্রণে। পরে ওই আইডি থেকে হ্যাকার বিভিন্ন ধরনের মানহানিকর পোস্ট দেয়। হ্যাকার আনোয়ারের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায় তার আইডি হ্যাক করে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য এবং ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির স্ক্রিন রেকর্ডিং সংরক্ষণ করেছে। হ্যাকারের চাহিদামত টাকা দিলে আইডি ফিরিয়ে দিবে এবং কোনো ক্ষতি করবে না। আর যদি চাহিদামতো টাকা না দেয় তবে তার ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক বন্ধদের ট্যাগ করে শেয়ার করে দিবে।

আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করি। ২৭শে ফেব্রুয়ারি আমার আইডি হঠাৎ করে হ্যাক হয়ে যায়। তারপর ওই হ্যাকার আমাকে প্রথমে মেসেঞ্জারে পরে আমার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে নানা রকম হুমকি, ভয়ভীতি ও বকাবকি করতে থাকে। আমাকে হুমকি দিয়ে বলে যদি তার চাহিদামতো টাকা না দেই তবে আমাকে নাস্তিক, দেশদ্রোহী ও জঙ্গি বানিয়ে জেলে পাঠাবে। আমার পরিচিত ব্যক্তিদেরকেও আমার হয়ে টাকা চাইতে থাকে। তিনি বলেন, আমি তাকে টাকা দেয়ার নাম করে ঘুরাতে থাকি। তারপর থানায় জিডি করি। যখন মামলার এজাহার লেখা চলছিল তখনো সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছিল। পরে আমি কৌশলে তার কাছ থেকে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল নম্বর নিয়ে আসি। ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তাকে সাইবার টিম গ্রেপ্তার করে।

ভুক্তভোগী এক কলেজপড়ুয়া তরুণী বলেন, একদিন সন্ধ্যার পর অপরিচিত একটি আইডি থেকে আমার ছবি সংবলিত একটি লিংক আমার মেসেঞ্জারে আসে। আমার নিজের ছবি দেখে আমি ওই লিংকে ক্লিক করি। তারপর আমার আইডি ও পাসওয়ার্ড চাইলে আমি দেই। তার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মেসেঞ্জারে ফোন দিয়ে এক ব্যক্তি বলে আমার আইডি তার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমার ছেলে বন্ধুকে পাঠানো যাবতীয় ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও তার কাছে। এখন ৫০ হাজার টাকা দিলে আইডি ফিরিয়ে দিবে। না হলে আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ ছবি-ভিডিও পাঠিয়ে হেয় করবে। প্রয়োজনে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে ভাইরাল করবে। উপায়ান্তর না পেয়ে আমি তার কথামতো ৫০ হাজার টাকা দেই। কিন্তু টাকা পেয়েও আমার আইডি ফিরিয়ে দেয়নি। ফের আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আরও টাকা নিতে থাকে। প্রায় দেড় লাখ টাকা দিয়ে আমি আইডি উদ্ধার করেছি।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল হক বলেন, লিটন পেশাদার হ্যাকার। অল্প সময়ের ভেতরে সে আড়াই হাজার আইডি হ্যাক করেছে। আমরা দুটি জায়গা থেকে আড়াই হাজার আইডি হ্যাকের সন্ধান পেয়েছি। এর বাইরে কোথাও আছে কিনা সেই বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। হ্যাক করা আইডির মধ্যে দেশি বিদেশিসহ নারী পুরুষের আইডি রয়েছে। তিনি বলেন, আইডি হ্যাক করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও অন্যান্য তথ্য নিজ আয়ত্বে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করা। টাকা না দিলে মানুষকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখাতো। সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে অনেকেই টাকা দিতো। তার কাছে ১০টি সিম পাওয়া গেছে। এসব সিমের কয়েকটিতে রকেট, বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট খোলা। এসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নিতো।

নাজমুল হক বলেন, আইডি হ্যাক থেকে বাঁচতে হলে সাইবার স্পেসে অপরিচিত কোনো আইডি থেকে পাঠানো লিংকে প্রবেশ করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিত কোনো আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আইডিতে সিকিউরিটি সেটিংস ব্যবহার করে রাখতে হবে। কোনো স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি ও ভিডিও শেয়ার করলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়াও ঘন ঘন আইডির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করলে হ্যাকাররা আইডি হ্যাক করতে পারবে না।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!