খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ৪ দিনের সরকারি সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি দল
  পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪৫

রমযানের ১০টি প্রস্তুতি

মুফতি আনিস বিন ওমর

যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমরা পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকি। পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা করে কাজ করলে সহজ, সুন্দর ও সুচারুরূপে কাজ সম্পাদন করা যায় এবং সর্বোচ্চ ফায়েদা অর্জন করা যায়। রহমত, ক্ষমা আর মুক্তির বার্তা নিয়ে মাহে রমযান আগতপ্রায়। যার মর্যাদা ও ফজিলত সীমাহীন। কুরআন ও কুরআন নাযিলের মাস রমযানুল মুবারক উম্মতে মুহাম্মাাদীর জন্য আল্লাহ তা’আলা এক বিশেষ অনুগ্রহ। পরকালীন পুঁজি সঞ্চয় করার জন্য নেকী উপার্জনের মৌসুম হিসেবে মানব জীবনে রমজানের গুরুত্ব অতুলনীয়। তাই মাহে রমজানকে স্বাগত জানাতে ও তার প্রাপ্তিগুলো লুফে নিতে আমরা যে সকল প্রস্তুতি নিতে পারি তা হলো-

বেশি বেশি ইস্তেগফার করা
কেউ যদি আগে থেকেই অপরাধী আর আল্লাহর কাঠগড়ার আসামী হয়ে থাকে, নতুন করে আমলের তাওফিক পাওয়া তার জন্য কঠিন। এছাড়াও وَاللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ আল্লাহ তা’আলা চান তোমরা তার কাছে তওবা কর-সুরা নিসা ২৭। তাই প্রত্যেকের জন্য উচিত, তওবা-ইস্তেগফার করে গুনাহ থেকে ফিরে আসা এবং নিজেকে ইবাদতের তাওফিক পাওয়ার উপযুক্ত করে তোলা ।

শারিরীক প্রস্তুতি
প্রত্যেক ইবাদত আদায়ের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে। যেমন হজ্জ, যাকাত আদায়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন। তেমনি রোজা এমন একটি ইবাদত যা আদায়ের মৌলিক পুজি হল সুস্থতা। সিয়াম পালন তথা সারাদিন পানাহার ছাড়া থাকা নিঃসন্দেহে কষ্টের কাজ। সুতরাং রমজানের আগে সাস্থ্যের সুষ্ঠু পরিচর্যার বিকল্প নেই। হাদীস শরীফে আছে إِذَا بَقِيَ نِصْفٌ مِنْ شَعْبَانَ فَلَا تَصُومُوا অর্ধ শাবানের পর আর রোজা রেখনা। তিরমিযী -৭৩৮। সুস্থতার সাথে সুন্দরভাবে রোজাগুলো রাখতে প্রয়োজনে আগে থেকই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

মানষিক প্রস্ততি
রমযানে সর্বোচ্চ সওয়াব হাসিলের জন্য মনকে পরিপূর্ণরুপে প্রস্তুত করা। নিজের উপর চাপ মনে না করে আনন্দের সাথে রোজা রাখার আগ্রহ তৈরি করা। আমার পরকালীন ব্যংকে জমা রাখার জন্য উপর্জন, এতে আমার লাভ, এটা আমাকেই করতে হবে এমন মানষিকতা পেষণ করা। সাথে সাথে রমজানের গুরুত্ব, ফজিলত, মর্যাদার কথা পরস্পর আলোচনা করা। এতে মনে আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

নিজের সন্তানাদি ও অধীনস্থদের রোজার রাখার প্রতি আগ্রহী করে তোলা। বাচ্চাদের রোজা রাখানোর ব্যাপারে আমাদের মধ্যে অনেক শিথিলতা রয়েছে। দূর্বল হয়ে যাবে বা শরীর খারাপ হবে এই ভয়ে তাদেরকে রোজা রাখতে দেইনা। এটা ঠিক না, বরং রোজার রাখার মত শক্তি হলেই তাদেরকে রোজা রাখতে নির্দেশ দেওয়া উচিত। عَنِ ابْنِ سِيرِينَ قَالَ: ্রيُؤْمَرُ الصَّبِيُّ بِالصَّلَاةِ إِذَا عَرَفَ يَمِينَهُ مِنْ شِمَالْهِ، وَبِالصَّوْمِ إِذَا أَطَاقَهُ হযরত ইবনে সিরিন রহ. থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন- যখন বাচ্চারা ডান বাম চিনতে শিখে তখন নামাযের নির্দেশ দিতে হবে, আর যখন রোযা রাখতে (না খেয়ে থাকতে) সক্ষম হবে তখন থেকে রোজার নির্দেশ দিতে হবে। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক -৭৩৯০। তাই ৯ বছর থেকে বাচ্চাদের রোজা রাখতে অভ্যাস করানো উচিত।

অর্থনৈতিক প্রস্তুতি
সিয়াম পালনকালে যেন আমার অর্থনৈতিক পেরেশানীতে পড়তে না হয় সে জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে একমাসের খরচের জন্য একটা ছোট্ট বাজেট প্রণয়ন করা যেতে পারে। কি পরিমাণ খরচ হতে পারে সে পরিমাণ অর্থ ব্যবস্থা করে রাখা। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য রমজান উপলক্ষে প্রত্যেক মাসে কিছু কিছু করে অর্থ জমানো উচিত। প্রয়োজনে এ মাসের জন্য ঋণ গ্রহণ করা যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা ঋণ পরিশোধ সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।

প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ
রমজান মাসের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো যথাসম্ভব পূর্ব থেকে ব্যবস্থা করে রাখা। রমযানে আল্লাহ তা’আলা খাবার নিয়ন্ত্রণের বিধান দিয়েছেন, তাই খুব বেশি ভোজের আয়োজন না করা এবং খাবারের বিলাসিতার পিছে না পড়া উচিত।
রমযানে বাজার-ঘাট, খাদ্য-সামগ্রী ও অন্যান্য আসবাবপত্রের পিছনে পড়ে যেন রমযানের মূল্যবান সময় নষ্ট না হয় পূর্ব থেকেই সে ব্যবস্থা করে রাখা।

কাজা রোজা আদায় করা
বিগত রমযানের কোন রোজা কাজা থাকলে এই রমযানের আগেই তা আদায় করা। বিভিন্ন সমস্যা, অসুস্থ্যতা বা অন্য কোন কারণে বা মহিলাদের প্রাকৃতিক কারণে রোজা কাজা হয়ে যায়। আজ না কাল রাখবো, গরমকালে না শীতকালে রাখবো, এজাতীয় অলসতা করে সেগুলো সাধারণত আদায় করা হয়ে ওঠে না। তাই রমযান আসার আগেই বিগত কাজা রোজাগুলো আদায় করে জিম্মা মুক্ত হয়ে আগত রমযানের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত। عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، تَقُولُ: ্রكَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ، فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَ إِلَّا فِي شَعْبَانَ  আবু সালামা রা. বলেন আমি আয়েশা রা. থেকে শুনেছি, তিনি বলেন ‘ আমার উপর রমযানের যে রোজা কাজা হয়ে যেত তা (রসুল স. এর সাথে ব্যস্ততার কারণে) পরবর্তী শাবান মাস ব্যতিত আদায় করতে পারতাম না। বুখারী ১৯৫০।

বিগত রমযানে আমলের ঘাটতির কারণ চিহ্নিত করা
বিগত রমযানে ইবাদত পরিপূর্ণরুপে কেন করা হয়নি ? কেন গত রমযানে কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামায, জিকির বেশি বেশি করতে পারিনি ? কেন মানুষকে ইফতারি করানোসহ দান-সদকাহ বেশি বেশি করা হয়নি ? কেন আমার ইতেকাফ করার সৌভাগ্য হয় নি ? এগুলোর কারণ খুঁজে বের করা এবং এই রমযানে পূর্ব থেকেই তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া। সাথে সাথে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা-এই রমযানে আমি ওমুক আমল করবোই। এত খতম কুরআন তেলাওয়াত, এই পরিমাণ দান-সদকা, এই পরিমাণ নফল নামায তথা এই পরিমাণ নেকি অবশ্যই আমি অর্জন করবো।

ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হওয়া
প্রতিটি মানুষের কিছুনা কিছু ঝামেলা/পেরেশানী থাকে। বাড়িঘর, জমাজমি, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরণের ঝামেলা বা ব্যস্ততা থাকতে পারে। রমজান আসার আগেই ঝামেলা মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা এবং ইবাদতের জন্য যথাসম্ভব ফারেগ হয়ে যাওয়া। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন يَا ابْنَ آدَمَ تفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلَأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ হে বনি আদম, তুমি আমার ইবাদতের জন্য ঝামেলা মুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে সচ্চলতা দিয়ে ভরে দিবো। তোমার অভাব দূর করে দিবো….।- তিরমিযী-২৪৬৬, ইবনে মাজাহ-৪১০৭।

প্রতিদিনের রুটিন করে নেয়া
রমযানের প্রতিটি মুহুর্ত অত্যন্ত দামী। এই দামী সময়ের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রমজানের একটি রুটিন তৈরি করে নেওয়া চাই। রুটিন মেনে চললে সময়ের অনেক বরকত হয়। রমযানে কোন সময় কোন ইাবাদত করবো, কখন তেলাওয়াত করবো, নফল নামায কখন পড়বো ? কখন নির্জনে হাত তুলে আল্লাহর কাছে চাইবো ? জিকিরের সময় কখন থাকবে ? সর্বোপরি রমযানের একটি মুহুর্তও যেন আমার ইবাদত থেকে খালি না থাকে তার জনে আগে থেকেই একটি কার্যকরী রুটিন তৈরি করা এবং তা মেনে চলা। রসুল স. এরও রমযানে নিয়মিত কিছু অতিরিক্ত ইবাদত ছিল। শাইখুল হাদীস হযরত জাকারিয়া রহ. রমযানে এমন অতুলনীয় রুটিন মেনে চলতেন যাতে একটি মুহুর্তও ছুটে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। আপবীতী।

রোজার মাসআলা গুলো আগের থেকে জেনে নেয়া
জানা না থাকলে কোন কাজই সঠিক ও সুন্দর ভাবে সম্পাদন করা যায় না।মাহে রমজান আসে প্রায় ১বছর ঘুরে,তাই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে রমযানের অনেক কিছুই আমরা ভুলে যাই। সুতরাং রোজার বিধি-নিষেধ, করনীয়-বর্জনীয়, তাৎপর্য-আদব ও প্রয়োজনীয় সব বিষয় গ্রহণযোগ্য কিতাবাদি বা নির্ভরযোগ্য কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেওয়া উচিত। কিসে রোজা নষ্ট হয়, কিসে রোজার সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়, কিসে মাকরুহ হয়, কোন কাজগুলো রোজা থেকে করলেও রোজর কোন ক্ষতি হয় না, মহিমান্বিত রমযানে সিয়াম সাধনার পূর্ণতার জন্য এসব বিষয় অবগত থাকা অত্যন্ত জরুরী।

কুরআনে কারিমের তেলাওয়াত
রমযান মাস কুরআনের মাস। এই মাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো কুরআন পাকের তেলাওয়াত। যারা পারেনা তারা পূর্বেই তেলাওয়াত শিখে নেয়া। যারা অল্প পারে তারা বেশি পারা জন্য পূর্ব থেকই চর্চা শুরু করা। আর যারা ভালভাবে পারে তারা কুরআনের অর্থ জানা ও বুঝার চেষ্টা করা। আর যারা কুরআনের অর্থ মোটামোটি জানে তাদের কুরআনের ব্যাখ্যা, তাফসির ও গবেষণার জণ্য পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। যেন প্রতিটি মুমিনের রমযান হয় কুরআনময়। রবের কালাম নিয়েই কেটে যায় যেন বরকতপূর্ণ কুরআনের এই মাস।

চাঁদ দেখা
মানুষ তাই খোঁজে, যার প্রতি তার মনের টান আর আগ্রহ থাকে। রমযানের তালাশে থাকা রমযানের প্রতি আগ্রহের প্রমাণ বহন করে। রমযানের চাঁদা দেখা একটি সুন্নাত আমল। আজ এই সুন্নাত আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে। মাহে রমযানকে বরণ করে নিতে চাঁদ দেখার জন্য পশ্চিম আকাশে একটু অনুসন্ধান চালানো উচিত। নতুন চাঁদ দেখে রসুল স. এই দু’আ পড়তেন, اللَّهُمَّأَهِلَّهُعَلَيْنَابِالْأَمْنِوَالْإِيمَانِ،وَالسَّلَامَةِوَالْإِسْلَامِ،رَبِّيوَرَبُّكَاللَّهُ -সুনানে দারেমী ১৭৩০।

আল্লাহ কাছে বেশি বেশি দু’আ করা
আমলের তাওফিক পাওয়ার জন্য দু’আ করা। বান্দা যতই চেষ্টা করুক না কেন আল্লাহর তাওফিক না দিলে কোন ইবাদত করা সম্ভব হবে না । আবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ তেমাদের রব বলেন, আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। সুরা আল-মু’মিন-৬০।

মিনতি করে রবকে বলা, আল্লাহ, তোমার রহমত ও ক্ষমার মাসে কত মানুষ সৌভাগ্যশীলদের কাতারে নাম লেখাবে। কত মানুষ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। কত মানুষ জান্নাতি হয়ে যাবে। আল্লাহ, আমি যেন সেই সব সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি। তুমি আমাকে তাওফিক দাও। আমাকে সহজ করে দাও।

ভক্তি আর আগ্রহের সাথে পরিকল্পনা ও পূর্ব থেকে প্রস্তুতি নিয়ে সিয়াম পালন করলে রমজানের পূর্ণাঙ্গ বরকত ও পরিপূর্ণ ফজিলত হাসিল করা আমাদের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। তাঁর কাছে আমরা সাহায্য চাই। وَاللهُ الْمُوَفِّقُ তিনিই তাওফিক দাতা।

লেখক: শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা, খুলনা।

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!