খুলনা, বাংলাদেশ | ২৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৯ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  এনআইডির তথ্য ফাঁসের ঘটনায় সজীব ওয়াজেদ জয় ও জুনাইদ আহমেদ পলকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে কাফরুল থানায় মামলা
  হাইকোর্টে ২৩ জনকে অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ, আজ শপথ
১০ হাজার মানুষকে বোকা বানিয়ে

এবার ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘এলটি অনলাইন মার্কেটিং’

তরিকুল ইসলাম

খুলনার কয়রার দেয়াড়া গ্রামের দারিদ্র ভ্যান চালক সবুজ। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি দিনমজুর পিতার সাথে তিনিও মাঝেমধ্যে জীবিকার তাগিদে কাজে যেত বাইরের কোন শহরে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকা দিয়ে একটি গরুও কেনেন তিনি। তাদের আয়ে সংসার চলছিল মোটামুটি। এরই মধ্যে এলাকার এক স্বজনের প্ররোচনায় স্বপ্ন দেখেন লাখপতি হওয়ার। কষ্টে অর্জিত ১৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন ১৪ পিছ টি-শার্ট। শুরু করেন স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে এড দেখার কাজ। লাখপতি হওয়ার স্বপ্নে গরুসহ নিজের রোজগারের অবলস্বন ভ্যানটি বিক্রি করে আরও ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন আইডি। কিন্তু আজ তার আইডিতে ৪০ হাজারের ওপরে টাকা জমা হলেও তুলতে না পারায় নিঃস্ব হয়ে পাগল প্রায় তিনি।

সবুজের ছোট চাচি আমেনা দিনমজুর স্বামীর সংসার থেকে অল্প অল্প করে জমানো ১৪ হাজার টাকা দিয়ে আইডি খুলে ওয়ান ষ্টার হন। পার্শ্ববর্তী এসএসসি পাশ করা বাবু চলতি বছরে পিতার নামে সমিতি থেকে তুলে ২০ হাজার টাকায় আইডি কিনে শুরু করেন ব্যবসা। একই গ্রামের বেকার যুবক মোস্তাফিজুর রহমান নামে আরেক ব্যক্তি নিজে ১৪ হাজার টাকা দিয়ে ওয়ান স্টার হয়ে অন্য গ্রামের এক শিক্ষকের ২ স্টার বানানোর কথা বলে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নিয়ে ১৪৪ টি আইডি কিনে দেয়। মোস্তাফিজুরের নিজের টাকা নিয়ে চিন্তা না করলেও চরম বিপদে পড়েছেন ওই শিক্ষকের টাকা নিয়ে।

সবুজ, আমেনা, বাবু কিংবা মোস্তাফিজুর নয়, ওই এলাকার ১০ শ্রেণির মেহেদী হাসান, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া খালিদ হাসান বাপ্পী, দিন মজুর শাহিনুর রহমান, শরিফুল ইসলামসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার শত শত মানুষ কোম্পানীর কর্মকর্তাদের প্ররোচনায় প্রলোভনে পড়ে লাখপতির আশায় আইডি খুলে খুইয়েছেন অর্থ-সম্পদ, অনেকে হয়েছেন নিঃস্ব

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই কোম্পানীতে সারাদেশের এমনিই চার লাখের বেশি আইডির মাধ্যমে প্রায় ২ বছরে ৪০ কোটি টাকার ওপরে জমা পড়ে। তবে একজন একাধিক আইডি খোলায় সক্রিয় কর্মী রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার। যার অধিকাংশই খুলনা বিভাগের মানুষ। আর খুলনা বিভাগের মধ্যে বেশি ছড়িয়েছে ঝিনাইদহ ও খুলনা জেলায়।

কোম্পানী সূত্রে জানা যায়, গ্রাহকের প্রতি আইডির দাম এক হাজার টাকা। আর এক আইডি দিয়ে ২২০ দিন পর্যন্ত দৈনিক বিজ্ঞাপন দেখে পাওয়া যাবে ১২ টাকা। আর ১৪ টি আইডি খুললে তাকে দেয়া হয় ‘ওয়ান স্টার’, ১৪৪ টি আইডি খুললে ‘টু স্টার’ এভাবে গ্রাহককে প্রলোভন দেখিয়ে নতুন নতুন আইডি খুলিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিচ্ছে তারা।

বেকারত্বের সুযোগে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের সহজ সরল মানুষদের টার্গেট করে এভাবে প্রায় ৪০ কোটির ওপরে টাকা লুফে নিয়েছে এলটি অনলাইন মার্কেটিং নামের এই প্রতিষ্ঠান।কোম্পানিটি শুরুতে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে গ্রাহককে টাকা তোলার সুযোগ দিলেও যখন এই গ্রাহকের প্রদত্ত অর্থ ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যায় তখনই বেরিয়ে আসে কোম্পানিটির আসল চেহারা।

আরও জানা যায়, টি-শার্ট বিক্রি করে টাকা নেয়ার পাশাপাশি তাদের শেয়ার ও ডিলার বিক্রিসহ গ্রাহকের বিজ্ঞাপন দেখা অর্থ পরিশোধ না করে মোবাইল রিচার্জ ব্যবসার নামে নতুন প্রতারণার ফাঁদ। তাছাড়া আরও চালু করে ১৪/২০ নামের আরেকটি প্রতারণার ফাঁদ।

ঝিনাইদহ জেলার কালিগন্জ এর আড়পাড়া গ্রামের খোরশেদ আলম কোম্পানির এমডি নামে পরিচিত আর চেয়ারম্যান হিসেবে আছে শামিম নামে ঝিনাইদহের আরেক ব্যক্তি। এছাড়া ঝিনাইদহের বাবুল ও আঃ রাজ্জাক এ কোম্পানি উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। আরো আছে নড়াইল এর হামিম, যশোরের নওয়াপাড়ার তৌহিদ ও চট্টগ্রামের কামরুল ইসলাম রিয়াদ। তাজুল ইসলাম তাজ নামের একজন পরিচালক হিসেবে পরিচিত। কোম্পানীটি ২০২০ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গ্রাহকের টাকা নিয়ে তালবাহনা শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে কোম্পানীর নামে সংগ্রহ করা একটি ট্রেড লাইসেন্সের কপি পাওয়া যায়। সেখানে  কোম্পানীর ঠিকানা দেয়া হয়েছে ২১৩/৪ এফ-৩ শাপলা হাউজিং পশ্চিম আগারগাঁও, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭।

এ বিষয় ভুক্তভোগী একাধিক গ্রাহকের সাথে কথা হলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সরলতার সুযোগে লাখ লাখ টাকা নিয়ে ফেরত দিতে নানা তালবাহনা করছেন। অথচ দেখার কেউ নেই। আমরা আমাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চাই এবং এই ব্যবসার সাথে জড়িত প্রতারকদের কঠিন শাস্তি চাই।

গ্রাহক সূত্রে জানা যায়, এরা লোকজনের টাকা নিয়ে শপিংমল, এলটি ফিড কারখানা, গার্মেন্টস কারখানাসহ নানাবিধ ব্যবসার আয় থেকে লভ্যাংশ গ্রাহকের মধ্যে বন্টন করতো বলে বলা হত।

আরও জানা যায়, শুধু খুলনা অঞ্চলে নয় এই চক্রটি এখন সারাদেশে ব্যবসা চালাতে নতুনভাবে প্রতারণা শুরু করতে নতুন নতুন কৌশল বের করছে। তাই এই চক্রের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কোম্পানির সকল গ্রাহক মামলাসহ মানববন্ধন করার জন্য কাজ করছে এবং গ্রাহকরা এ প্রতারকদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে সকলের টাকা দ্রুত পরিশোধ করার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি ও প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির এমডি খোরশেদ আলম ও চেয়ারম্যান শামীমের মুঠোফোনে একাধিক বার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি।

তবে পরিচালক হিসেবে পরিচিত তাজুল ইসলাম তাজের সাথে ফোনে কথা হয়। তিনি জানান, চার লাখের বেশি আইডি রয়েছে। আর তারা বাইনারী পদ্ধতিতে ই-কমার্স ব্যবসা করছেন। বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে লভ্যাংশ গ্রাহকের মধ্যে বন্টন করছেন। এমএলএম’র সিস্টেমে করছেন কিনা এবং এমএলএম’র লাইসেন্স আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি এমএলএম নয়, ই-কমার্স। আর জয়েন্ট স্টকের ব্যবসায়িক লাইসেন্স রয়েছে তাদের। ব্যবসা করলে নিম্নমানের একটি টি-শার্টের মূল্য ১ হাজার টাকা নিচ্ছেন কেন ? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন একই পণ্যের দাম স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। গ্রাহকের টাকা উইড্রো’র বিষয়ে জানান, ই-কমার্স খাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করায় সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। তবে মার্চের প্রথম দিকে সমাধানে আসতে পারবেন তারা। নিউজ করার কারণে প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়লে ১০ হাজার গ্রাহকের বদদোয়া লাগবে এটা বলে মিষ্টি ভাষায় এই প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ করতে নিষেধও করেন তিনি।

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!