শিল্পের মুখ্য শর্ত হচ্ছে সারল্য। শিল্প হবে চিন্তার অকপট প্রকাশ। এমন ভাবনায় ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিল্পের আবেদন। রুচির দুর্ভিক্ষকে সরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন শিল্পের পথরেখা। তারই শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টায় যাত্রা শুরু করে এ দেশের চারুকলা। আপন মনন ও সৃজনশীলতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত করেছেন বাংলার চিত্রকলার ভুবনকে। অনন্য সব শিল্প সৃষ্টি করে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতিকে। আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের পথ দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। আজ বুধবার দেশের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃত্ এই কিংবদন্তি শিল্পীর ১০৭তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৮তম জন্মদিন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই পথিকৃত্ চিত্রশিল্পী।
বরাবরের মতো শিল্পাচার্যের জন্মদিন উপলক্ষে জয়নুল উত্সবের আয়োজন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। আজ বুধবার সকালে অনুষদ প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী জয়নুল উত্সব ও জয়নুল মেলার উদ্বোধন হবে। এবার জয়নুল মেলায় অনুষদের আয়োজনে সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। সকালে উত্সব উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিসচিব মো. আবুল মনসুর। বিশেষ অতিথি থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক আহমেদ উল্লাহ এবং শিল্পাচার্যপুত্র খায়রুল আবেদিন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদান করা হবে জয়নুল সম্মাননা। চারুকলা শিক্ষা বিস্তারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই সম্মাননা প্রদান করা হবে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আবদুস শাকুর শাহ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় শিল্প-ইতিহাসবিদ রমন শিব কুমারকে। দিনব্যাপী জয়নুল মেলার পাশাপাশি তিন দিনের উত্সবে বিকেলে থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উত্সবের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পাতিবার পটুয়া কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে তাকে নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। জয়নুল আবেদিনের একজন সার্থক ছাত্র ও সহকর্মী হিসেবে কামরুল হাসানের মূল্যায়নধর্মী আলোচনা করবেন চারুকলা অনুষদেন ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন ও শিল্পী ঢালি আল মামুন।
বাংলাদেশে চারুকলার চর্চা ও আন্দোলনের দিশারি বিরল প্রতিভার অধিকারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ ও মা জয়নাবুন্নেছা। বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত, সুনিবিড় ও রূপময় প্রাকৃতিক পরিবেশে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রং-তুলির খেলায় ফুল-ফল, বৃক্ষ, লতাপাতা, মাছ, পাখিসহ নানা বিষয়কে মেলে ধরতেন ক্যানভাসে। আর এই ছবি আঁকার টানেই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এখানেই চলে শিল্পাচার্যের চারুশিক্ষার দীক্ষা। ১৯৩৮ সালে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম প্রেণিতে প্রথম হয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি। ততদিনে শিল্পী হিসেবেও শিল্পরসিকদের স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছেন। স্থান করে নেন মুষ্টিমেয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর তালিকায়। এরপর তিনি কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়।
এ দেশের শিল্পের ভিত রচনায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জয়নুল আবেদিন। তার হাত ধরেই বিকশিত হয় এ দেশের চারুশিল্প মাধ্যম। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আধুনিক শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। আর শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন এবং এর সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাঙ্ক্ষায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
শিল্পীজীবনে রং-তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ১৯৬৯ সালে তার ক্যানভাসে উঠে এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ১৯৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম নবান্ন। একই বছরে মনপুরা নামে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের হূদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেছেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি।
শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুন টানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য ও বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহা তার তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছিলেন। শিল্পকলার সুবাদে বাঙালি সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বদরবারে। একই সঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিমজ্জিত রেখেছিলেন নিজেকে।
১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। তারা হলেন সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জয়নুল আবেদিন।