কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে গত ২৭ জুন করোনা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ডাঃ উষা। রোগী হিসাবে ভর্তি হলেও অন্য রোগীদের কাছে ছিলেন ডাক্তারের ভুমিকায়। বিশেষ করে রাত হলে রীতিমত নাইট ডিউটি করতেন তিনি। তাকে কাছে পেয়ে রোগীরা নিজের রোগের কথা বলতেন, তিনিও প্রয়োজনীয় সমাধান দিতেন। সাথে নিয়ে যেতেন নিজের কাছে থাকা বিভিন্ন ধরণের ফল। করোনা হাসপাতালে তার থাকাকালীন একাধিক রোগী ও তার স্বজনদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা যায়।
ডাঃ সাদিয়া মনোয়ারা উষা, দায়িত্ব পালন করছেন খুলনা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) হিসাবে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ জেলার সকল হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় তাকে। সব জায়গার করোনা নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো, সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর গ্রাফিক্সের মাধ্যমে সহজভাবে উপস্থাপন করে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়সহ প্রয়োজনীয় সকল দপ্তরে পাঠান তিনি। এ কাজে অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে। আর করোনা রিপোর্টের এ কাজের মাধ্যমে তিনি খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এমনকি মিডিয়াকর্মীদের কাছেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
আরও পড়ুন : জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খুলনায় কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা, আক্রান্ত ২৮০
ডাঃ সাদিয়া মনোয়ারা উষা শুধু একজন নিষ্ঠাবান চিকিৎসকই নন। একই সাথে তিনি একজন জাতীয় পুরষ্কার পাওয়া কন্ঠ শিল্পী। তবে চিকিৎসা পেশাকেই তিনি মূল দায়িত্ব হিসাবে অনুভব করেন। ডাঃ উষা যশোর জেলার মথুরামপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল সামাদ ও মা রওনাক রায়হানা রিনা। তিন ভাই- বোনের সবার বড় তিনি। ছোট ভাই মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে লেফটেন্যান্ট হিসাবে কর্মরত ও ছোট বোন অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী।
তিন বছর বয়সেই ছবি আকার মাধ্যমে ছড়াতে থাকে তার প্রতিভার আলো। পাঁচ বছর বয়স থেকে আবৃত্তি, বিতর্ক ও গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। ছবি এঁকে ১১টি আন্তর্জাতিক ও একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। নতুন কুড়ি , জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে স্বর্ণ ও রৌপ্য অর্জন করেছেন এই চিকিৎসক।
আরও পড়ুন : মানুষ সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করতে চান ডাঃ মিজানুর
এরপর বিটিভির আলোর শতদল ও বাংলাদেশ বেতারেও প্রোগ্রাম শুরু করেন তিনি। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে যশোর বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন ডাঃ উষা। খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে কে-১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসাবে এমবিবিএস পাশ করেন। চাকুরী জীবনে যশোর সদর মেডিকেল অফিসার (মেটারনিটি এন্ড চাইল্ড হেলথ) , পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পর ফুলতলা উপজেলা হয়ে মার্চ মাসে খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রন) পদে যোগদান করেন তিনি।
করোনার শুরুতে খুলনায় যখন ব্যাপক করোনা ভাইরাসের প্রভাব, তখন ডাঃ ঊষা একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত খুলনায় যে কয়েকজন চিকিৎসককে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে ডাঃ উষা তাদের মধ্যে অন্যতম।
আরও পড়ুন : রোগী ও চিকিৎসকদের ভরসাস্থল ডাঃ মেহেদী নেওয়াজ
করোনা পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে সকাল থেকেই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল, সদর হাসাপাতাল, করোনা হাসাপতাতালসহ প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার যোগাযোগ থাকে প্রতিনিয়ত। একই সময়ে তথ্য সংগ্রহ করে দুপুর ১২টার মধ্যে করোনা প্রতিবেদন তৈরী করেন তিনি। পরে বিকাল ৪টার মধ্যে ওই প্রতিবেদন গ্রাফিক্সের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রেরণ করেন। এ ভাবেই বিরতিহীনভাবে দিন কাটে তার।
ডাঃ উষা খুলনা গেজেটকে বলেন, তার বাবা ১৯৭১ সালে দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে যুদ্ধে নেমে ছিল। ঠিক তেমনি বাবার মত করোনার সাথে তার যুদ্ধ করতে হয়েছে বেশ কিছু দিন। গত ২৭ জুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি । ওই দিনই তাকে খুলনা করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজে রোগী হয়েও অন্য রোগীদের কাছে ছুটে গিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ১১ জুলাই উষার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। সুস্থ হয়ে ফিরে যান নিজ কর্মস্থলে। সর্বশেষ নিজের পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দকে বিসর্জন করে নিজ দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়ে ছিলেন কর্মস্থলেই।
কন্ঠ শিল্পী, কবিতা লেখক ও চিকিৎসক ঊষা গান করেছেন বেশ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলেও। বর্তমানে তিনি খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী।
আরও পড়ুন : চাকুরী জীবনের শেষ সময়টুকুও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে চান ডাঃ ফরিদ উদ্দিন
খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রন) ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা বলেন, আতঙ্কিত হয়নি। যুদ্ধ করতে নেমে একটুও আক্রান্ত হবো না তা কি হয় ? উপসর্গ গুলোর তীব্রতা বিবেচনা করে হাসপাতালে আইসোলেশনকে উত্তম বলে বেছে নিয়েছিলাম। দীর্ঘ চার মাস কন্ট্রোল রুমে টানা ডিউটি করার পর হাসপাতাল ও রোগী দেখে মনে হল ঠিক জায়গাতেই এসেছি। তাই নিজে অসুস্থ হলেও চেষ্টা করেছি আশে পাশে রোগীগুলোর কাছে যেয়ে কথা বলতে। সাধ্যমত সেবা করতে। প্রতিনিয়ত তাদের কথা চিন্তা করেছি। রোগী নয়, একজন চিকিৎসক হিসেবেই তাদের সেবা করে গেছি।
খুলনা গেজেট / এমবিএইচ / এমএম