‘অনেক পরিকল্পনা ও শ্রমের ফসল কপিলমুনির ঘাঁটির যুদ্ধটি’, শিরোনামটি রণাঙ্গণের সম্মুখ সমরের বীরসেনানী মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯নং সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার মোঃ ইউনুস আলী ইনুর কণ্ঠে উচ্চারিত। কিভাবে টানা যুদ্ধে পতন হয় খুলনার কপিলমুনি ঘাঁটি, তাঁর স্মৃতিচারণে সে বর্ণনায় উঠে এসেছে জেষ্ঠ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দীর ক্ষুরাধার লেখনীতে। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনুর যুদ্ধের অম্লান স্মৃতিতে প্রকাশিত হয়েছিল। আজ এই বীরমুক্তিযোদ্ধা আর আমাদের মাঝে নেই। তার স্মৃতির প্রতি খুলনা গেজেট পরিবারের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা। পাঠকের সামনে কালের কণ্ঠে’র সেই প্রতিবেদনটি তুলে ধরছি।
খুলনা মহানগরের দৌলতপুর থানার পাবলার কুণ্ডুপাড়ার শেষ প্রান্তের এলাকাটি অনেকটা গ্রামের মতো। ইট বিছানো আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে পুকুর আর গাছপালার মাঝে উঁকি দেয় একটি সাদামাটা আধাপাকা বাড়ি। নাম কমান্ডারবাড়ি। কারণ বাড়ির মালিক মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার। এলাকার বয়স্ক লোকজন এক নামে চেনেন ওই বাড়ির মালিক মুজিববাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইউনুস আলী ইনুকে। ৭৬ বছর বয়স আর স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় মানুষটি বেশ মিইয়ে গেছেন; বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি গিয়েছিলেন ডা. শেখ বাহারুল আলমের চেম্বারে। পরে সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। যুদ্ধদিনের কথা উঠতেই তাঁর চোখ দু’টি জ্বলজ্বল করে ওঠে। কপিলমুনির যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠতেই ইউনুস আলী ইনু বলেন, ‘অনেক পরিকল্পনা ও শ্রমের ফসল ওই যুদ্ধটি।’
খুলনার মুজিববাহিনীর সদস্যরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাইয়ের শেষ দিকে শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে সীমান্ত পার হয়ে সাতক্ষীরায় ঢোকেন। টুকু ছিলেন কমান্ডার, ইউনুস আলী ইনু ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার। তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান হিসেবে ইনু সেখানে থাকতেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনু বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলে কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটিটি ছিল সবচেয়ে বড়। কপিলমুনি বাজারের প্রতিষ্ঠাতা রায়সাহেব বিনোদবিহারী সাধুর দো’তলা দুর্গের ন্যায় বাড়িটি দখলে নিয়ে সেখানে রাজাকাররা ওই ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। ঘাঁটিটি ধ্বংস করার জন্য খুবই ভাবতে থাকি। একাধিকবার টুকু ভাইকে তাগাদা দিই। আগে কয়েকবার এই ঘাঁটি আক্রমণ করে সফল হওয়া যায়নি। তাই আমরা বেশ সতর্কতা অবলম্বন করি।’ ইনু জানান, পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার আগে তিনি ঘাঁটিটি রেকি করেন। এক দিন পর তালা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। ইনু তখন সেখানে ছিলেন না। তবে হামলাকারীরা সেদিন মাগুরা গ্রামের ৩৫ জনকে হত্যা করে।
ওই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আক্রোশ আরো বেড়ে যায়। তাঁরা অতি দ্রুত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেন। একক কোনো গ্রুপের পক্ষে ক্যাম্পটি দখল করা সম্ভব হবে না। এমনটি মনে করে টুকু ও ইনুর গ্রুপ মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে মিলে চূড়ান্ত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। অন্যান্য গ্রুপের নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন স ম বাবর আলী, গাজী রহমতউল্লাহ, লেফটেন্যান্ট সামসুল আরেফিন, আব্দুস সালাম মোড়ল, সাহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু, গাজী রফিকুল ইসলাম ও শেখ আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ। ঠিক হয়, ৪ ডিসেম্বর রাত ৩টায় তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হবে। মাদ্রা গ্রাম থেকে কপিলমুনির উত্তর ও পূর্ব অংশে আক্রমণ করার দায়িত্ব নেন কমান্ডার ইনু। দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে আক্রমণ করার দায়িত্ব পড়ে স ম বাবর আলী, রহমতউল্লাহ ও লেফটেন্যান্ট আরেফিনের ওপর।
ইউনুস আলী বলেন, ‘এই যুদ্ধটি ভয়ানক হবে বলে আমাদের পরিকল্পনাও ছিল বেশ সুগঠিত। আক্রমণের লক্ষ্যে স ম বাবর আলী ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বাধীন ৫০জনের মুক্তিসেনা দলটি নাসিরপুর ব্রিজ পার হয়ে রাজাকার ক্যাম্পের পুব পাশে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। রহমতউল্লাহ ও ওমর ফারুক তাঁদের বিস্ফোরক দল নিয়ে অবস্থান নেন শিবিরের উভয় দিকে। আবু ওবায়দার দলটি আরসিএল নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পের পশ্চিমে কাপোতাক্ষ নদের ওপারে কানাইদিয়ার ক্যাম্প থেকে ফায়ার করার জন্য তৈরি হয়। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নেতৃত্বে এক দল অবস্থান নেয় আরসনগর। সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের, যাতে পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকাররা কপিলমুনির দিকে না আসতে পারে। নৌ কমান্ডো বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে একটি দল রাজাকার ক্যাম্পের পাঁচিল ও মূল ঘাঁটিতে বিস্ফোরক লাগানোর দায়িত্বে ছিল। আব্দুস সালাম মোড়লের নেতৃত্বে রশীদ, মকবুল, সামাদ মাস্টারসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাঁটির ২৫ থেকে ৩০ গজ দূরে অবস্থান নেয়, যাতে তারা রাজাকার ঘাঁটির বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে পারে। আজিজুল হকের নেতৃত্বে ১০ জনের আরেকটি দল ছিল একটু দূরে পাইকগাছার শিববাটি নদীর মোহনায়। ভাসমান মাইন নিয়ে তারা অপেক্ষায় ছিল, যাতে নৌপথে রাজাকারদের সহায়তায় কোনো গানবোট আসার চেষ্টা করলে সেগুলো উড়িয়ে দেয়া যায়।
বীরমুক্তিযোদ্ধা ইউনুস আলী ইনুর নিথর দেহ
কমান্ডার ইনু বলেন, ‘এই যুদ্ধ পরিকল্পনার অন্যতম কৌশল ছিল রাজাকার ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রাখা। পরিকল্পনামতো ৪ ডিসেম্বর রাতে সবাই নির্দিষ্ট পজিশনে চলে যান। শুরু হয় আক্রমণ। দুই পক্ষেই বেশ গোলাগুলি চলতে থাকে। রাতের আঁধার কেটে ভোর হয়, সূর্যের আলোর তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণও বাড়তে থাকে। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়, একসময় দুপুরও পার হয়ে যায়, যুদ্ধ থামে না। কমান্ডাররা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন।’ তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধে প্রথম দিকে এলাকাবাসী আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। তাদের ভয় ছিল যে ঘাঁটির পতন না হলে এলাকাবাসীর ওপর রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু যুদ্ধের কৌশল দেখে একপর্যায়ে এলাকাবাসী আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। এতে রাজাকাররা একটি গণ্ডির মধ্যে আটকে যায়।’
এক রাতের যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে ইনু বলেন, ‘রাতে গুলি করতে করতে এগোচ্ছিলেন গাজী আনসার। হঠাৎ একটি গুলি তাঁর বুক ভেদ করে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শহীদি মৃত্যুবরণ করেন। ওই রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আরসিএলের সাহায্যে রাজাকার ক্যাম্পের ছাদের বাংকার উড়িয়ে দেন। পাঁচিলের অংশবিশেষও ধ্বংস হয়। এতে রাজাকাররা আর ছাদে আসতে পারছিল না। কালাম ছিল বালিকা বিদ্যালয়ে। ওই সময় আচমকা তোরাব আলী অন্য পথে এগোতে গেলে তিনি আহত হন। গুলি তাঁর পেটের এক পাশে লেগে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাঁকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। রুহুল আমিন গুলি করতে করতে এগোচ্ছিলেন। রাজাকাররা তাঁকে দেখে কয়েকটি গুলি করে। এতে ইটের দেয়াল ভেঙে তাঁর শরীরে লাগে এবং একটি গুলি তাঁর কুঁচকিতে লাগে। এর পরের দিন আহত হন খালেক। তাঁর দুই পা ভেঙে যায়। খালেক আহত হওয়ায় আনোয়ারের জেদ চেপে যায়। তিনি বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। এমন সময় একটি গুলি আনোয়ারের মুখে লেগে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।’
কমান্ডার ইনু বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর রাজাকাররা নমনীয় হয়। তারা বলে, বাবর আলীর সঙ্গে আত্মসমর্পণের কৌশল নিয়ে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমরা তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। অবশেষে ডিসেম্বরের ৭ অথবা ৮ তারিখে রাতের বেলা আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয় রাজাকাররা। এই যুদ্ধে ধরা পড়ে ১৭৭জন রাজাকার। উদ্ধার করা কাগজপত্রে দেখা যায়, তারা সেখানকার এক হাজার ৬০১ জনকে হত্যা করে; আরো এক হাজার মানুষকে হত্যা করবে। এমন একটি তালিকাও পাওয়া যায়।’ (সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ)
খুলনা গেজেট/এআইএন